।। অষ্টাদশ অধ্যায়।।

শেষ অধ্যায়ে যাওয়ার আগে আমরা আরও একটু বিস্তারিত আলোচনায় যাবো। সেই আলোচনা হবে আমার আরও তিনটে ভাবনা নিয়ে। সেই বিশেষ  তিনটে ভাবনা নিয়ে আলোচনা করলে,  ভাবনাগুলোকে প্রকাশ্যে আনলে,  আমার কর্ম ও ভাবনা নিয়ে গড়া আমার জীবনবৃত্ত ও কর্মবৃত্ত সম্পূর্ণ হবে বলেই আমার বিশ্বাস। এই বিশেষ  তিনটে ভাবনা মাথায় আসার আগে আমার মনে হতো এই পৃথিবীকে নিয়ে আমার ভাবনা, আমার কর্মধারা এবং মানুষের কাছে তা প্রতিনিয়ত তুলে ধরা- এই সমস্তই বোধ হয় আমি  একশো ভাগই  সম্পন্ন করে ফেলেছি। আমার নতুন করে আর কিছু ভাবার বা এই পৃথিবীর মানুষের কাছে তুলে ধরার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই! কত অবুঝ ছিলাম আমি আর কত অপরিণত ছিল আমার মন! কিছুদিন আগে যখন পরপর এই তিনটি ভাবনা আমাকে আলোড়িত করল, তখনই আমার মনে হল আমার এই ভাবনাগুলো মানুষের সামনে প্রকাশ করার পর আমি বলতে পারবো, পৃথিবী আমাকে যোগ্য মনে করে,- যে অতি গুরুভার আমার উপর ন্যস্ত করেছিলেন, তার অন্ততঃ আটানব্বই শতাংশ আমি সম্পন্ন করতে পেরেছি। কেন এই কথা বললাম, আশা করিআমার ভাবনাগুলো লিপিবদ্ধ করলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে!
আমার বিশেষ তিনটে ভাবনার প্রথমটি হলো পৃথিবীরও প্রাণ আছে। আমার এই ভাবনায় আমি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। কোন জড়বস্তু বা মৃতবস্তু কখনোই প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে না! এটি একান্তভাবে আমার নিজস্ব ভাবনা ও উপলব্ধি। মাটি থেকে উৎপন্ন হয় চারাগাছ আর কিছু সময় পরে সেই চারাগাছই ফুল-ফল সহ বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়! পৃথিবীর বুক থেকে রস শোষণ করে বেড়ে ওঠে কোটি কোটি গাছ, ঠিক যেমনভাবে মাতৃস্তন্য পান করে প্রতিমুহূর্তে বেড়ে উঠছে কোটি কোটি মানব শিশু। পৃথিবী জীবন্ত না হলে সেই স্নেহরস একটি শিশু চারা গাছ কিভাবে পেত!  আর একটা কথাও এই সঙ্গে আমার মনে হয়, আমরা প্রত্যেকেই যে কোন কাজই করি না কেন, খানিকক্ষণ সেই কাজ করার পরে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং বিশ্রাম নিই। আবার কোন সময় বেশি ক্লান্তি আমাদের গ্রাস করলে অথবা কাজে একঘেয়েমি এসে গেলে আমরা কিছুদিনের জন্য কাজ থেকে ছুটি নিয়ে নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় ঘুরে আসি। সাময়িক বিশ্রামে তরতাজা হয়ে আবার নতুন উদ্যমে কাজে যোগ দিই। আচ্ছা, যদি এমন হতো- কোটি কোটি বছর ধরে  কোটি কোটি জীব ও জড়ের অকল্পনীয় গুরুভার বহন করতে করতে কোন এক সুন্দর সকালে পৃথিবীরও মনে হতো- আমারও কয়েকটা দিন বিশ্রাম দরকার- তাহলে কি হতো? সেই মুহূর্তটিই হতো এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম অন্ধকার মুহূর্ত!  সমস্ত জীব ধ্বংস হয়ে যেত!  কিন্তু না, অপার করুণাময়ী পৃথিবী কখনোই তা হতে দেয় না! তাঁর রয়েছে প্রাণ আর সেই প্রাণেরয়েছে আমাদের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা। তাই তার কাজ থেকে ছুটি নেওয়ার কথা কখনোই মনে আসে না তার।
 এবারে যে দ্বিতীয় ভাবনা নিয়ে আমরা আলোচনা করবো সেটা হল  আর্থস রুল  বা পৃথিবীর নিয়ম। এটা ঠিক কি রকম ব্যাপার সেটাই এবারে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করবো। জন্মগ্রহণের পর  থেকেই মানুষ কিছু অলিখিত, প্রচলিত নিয়মকে অনুসরণ করে বেড়ে ওঠে। যেমন- ঘুম থেকে ভোরবেলা ওঠা,  প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে স্কুলে যাওয়া বা পড়তে বসা। দেশ ও মানুষকে সম্মান করা, গুরুজনদের কথা মান্য করা, বাবা- মাকে শ্রদ্ধা, ভক্তি করা ইত্যাদি। আমরা যখন কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত  হই তা শিক্ষা, সাংস্কৃতিক,  ক্রীড়া, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক যে কোন প্রতিষ্ঠানই হোক না কেন, সেই প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন থাকে এবং প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক সদস্যকে কঠোরভাবে সেই নিয়ম কানুন  মেনে চলতে হয়। যদি কেউ সেই নিয়ম মান্য না করেন তাহলে তাকে সেই নিয়ম না মানার কারণ  দর্শাতে হয়, কেন তিনি সেই নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের যদি সেই যুক্তি সঠিক বলে মনে না হয় তাহলে সেই সদস্যকে নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে শাস্তি পেতে হয়। এমনকি অভিযোগ গুরুতর হলে তাকে প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করাও হতে পারে। যদি ব্যাপারটা এইরকমই হয়, তাহলে যে পৃথিবীতে আমরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অতিবাহিত করি এবং মৃত্যুর পরেও ধূলিকণা হয়ে মিশে থাকি, সেই পৃথিবীতে সঠিকভাবে বসবাসের জন্য কি কোন নিয়ম থাকতে পারে না? পারে এবং অবশ্যই থাকা উচিৎ। তা হবে পৃথিবীর নিয়ম বা অনুশাসন! সেই অনুশাসন অনুযায়ী এই পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষকে হতে হবে   শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নিয়ম মেনে চলা মানুষ। পৃথিবীর মানব সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে  একটু চর্চা করলেই দেখা যাবে যে দেশ বা জাতি যত উন্নতির শিখরে আরোহন করেছে,  সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যত অভাবনীয় স্বাক্ষর রেখেছে- সেই দেশ এবং সেই জাতি ততটাই শৃঙ্খলাপরায়ন ও অনুশাসন মেনে চলা দেশ এবং জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে নিজেদেরকে মেলে ধরেছে। ঠিক তেমনি ভাবে পৃথিবীর অনুশাসন মেনে চললে পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষই হয়ে উঠবে শৃঙ্খলাপরায়ন ও অনুশাসন পালনকারী পৃথিবীর নাগরিক। অন্তর থেকে  শৃঙ্খলাবদ্ধ হলে মানুষ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠবে না। অকারণ  জিঘাংসায় ঝাঁপিয়ে পড়বে না কোন ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির উপরে,  ধ্বংস করবে না তার বাড়ি, ঘর, সম্পত্তি। কোন দেশ অন্য কোন দেশের ভূখন্ড আক্রমণ  করে অধিকার করার লোভ সংবরণ করবে। এক বিশ্বখ্যাত কবি প্রকৃত সৈনিকের কর্তব্য সম্পর্কে লিখেছিলেন-


দেয়ারস নট টু মেক রিপ্লাই
দেয়ারস নট টু রিজন হোয়াই
দেয়ারস বাট টু ডু অর ডাই


আমি শুধু একটা ছোট্ট বিষয় সংযোজন করতে চাই। পৃথিবীর নিয়ম-অনুশাসনকে মানুষ যখন অনুশাসন বা নিয়ম না ভেবে হৃদয় দিয়ে অনুভব করবে, ভালোবেসে অনুসরণ করবে তখন সমগ্র মানব জাতিই হয়ে উঠবেশৃঙ্খলাবদ্ধ  সৈনিকদল। পৃথিবী মায়ের  সৈন্যদল। পৃথিবীর নিয়ম আর অনুশাসন অনুসরণ করলে সেদিন আর খুব দূরে নয় যেদিন সমগ্র মানবজাতিই হয়ে উঠবে রেজিমেন্টেড গ্রেট সোলজারস অফ্‌ মাদার আর্থ।
তৃতীয় যে ভাবনা আমার মনে রেখাপাত করেছে সেটা হল একটা আর্থ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এই ব্যাংকের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমি মনে করি। এটা অনেকেরই জানা আছে, আবার অনেকের হয়তো জানা নেই, এই পৃথিবীর মোট সম্পদের পঁচাশিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র পনেরোটি দেশ আর মাত্র বাকি পনেরো শতাংশ মালিকানা বাকি সবকটি দেশের হাতে। এই ছোট্ট পরিসংখ্যানটিই বুঝিয়ে দেয় এই পনেরোটি দেশের সাথে বাকি দেশগুলোর আর্থিক বৈষম্য ঠিক কতখানি। এর ফলে বাকি দেশগুলিতে যখন কোভিড-১৯ এর মত  অতিমারী হানা দেয়  বা অন্য কোন মহামারী বা চরম কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় যখন আছড়ে পড়ে তখন সেই দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য একেবারে তছনছ হয়ে যায়। দারিদ্র ও বেকারত্ব বেড়ে যায় ভয়ংকরভাবে। এই অবস্থায় পথ দেখাতে পারে আর্থডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। বাঁচাতে পারে বিশ্বকে বা কোন দেশকে জাতীয় বিপর্যয়ের হাত থেকে। এই আর্থডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গড়ে তুলতে হবে অবিলম্বে। তাহলেই বিশ্বব্যাপী  অতিমারী বা অতি ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয় রুখে দেওয়া সম্ভব। একটি দিনের এক একটি মুহূর্ত এখন অত্যন্ত দামী। বিশ্বব্যাপী  অতিমারী কোভিড-১৯ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সামান্য গাফিলতি বা ঢিলেমির মনোভাব কি মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের গা- ছাড়া মনোভাব আর অসাবধানতার মূল্য চোকাতে হয়েছে আমাদের। এই আর্থডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গড়ে তুলতে গেলে বিশ্বের প্রত্যেক দেশ ও নাগরিকের আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন তা যতসামান্যই হোক না কেন বাধ্যতামূলকভাবে। এছাড়াও সারা পৃথিবী জুড়ে অতি বৃহৎ, বৃহৎ, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র- এরকম অজস্র ব্যবসায়ীক   প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে আছে। সেই সমস্ত ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনুদান যুক্ত হবে এই ব্যাংক তৈরি করতে। এবং তাদের এই অনুদানের ক্ষেত্রে সেই সব দেশের আয়কর সংক্রান্ত নিয়মের ক্ষেত্রে তারা বিশেষ ছাড় পাবে। বিশ্বব্যাপী যে কোন বিপর্যয়ে এই ব্যাংক তো পাশে থাকবেই, এছাড়াও যে আর্থস রুল বা পৃথিবীর অনুশাসনের বিষয়ে আগে আলোচনা করা হয়েছে, সেই আর্থস রুলবিষয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে সচেতন করে তোলা অত্যন্ত জরুরী। সেই সচেতনতা বৃদ্ধিতে চাই অতি নিবিড় ও ব্যাপক প্রচার। আর সেই প্রচারের জন্য চাই প্রচুর অর্থ। সেই অর্থ সরবরাহ করবে এই ব্যাংক। এক কথায়, মানবজাতির সার্বিক কল্যাণে-সর্বজনের অর্থে, সর্বজনের স্বার্থে এই আর্থডেভেলপমেন্ট ব্যাংক তৈরি হবে।