।। দ্বাদশ অধ্যায়।।

সেই প্রাচীনতম কাল থেকে পৃথিবীজুড়ে দুটি শব্দ চলে আসছে। ভগবান আর শয়তান। অর্থাৎ সু আর কু। বাংলা ভাষায় লিখছি বলে আমি বাংলায় লিখলাম ভগবান আর শয়তান কথা দুটো। পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায় এই শব্দদুটো আবহমান কাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যার অর্থ হলো  ভালো আর মন্দ। অর্থাৎ ভগবানকে ধরা হয় যা কিছু ‘সু’ বা ভাল তার পরাকাষ্ঠা হিসেবে আর শয়তানকে ধরা হয় ‘কু’ বা কিছু মন্দ বা খারাপ, তার প্রতীক হিসেবে । এই পৃথিবীতে যা যা ভাল হয়, আমাদের জন্য কল্যাণকর হয়, তার সবকিছুর জন্যই আমরা ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধা জানাই ভগবানকে। কোন বিপদে পড়লে বা আমাদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা জানাই ভগবানের কাছে। অন্তর থেকে বিশ্বাস করি, বিপদে তিনিই আমাদের রক্ষা করবেন। আর এই মনোভাবের ঠিক বিপরীত মনোভাব পোষণ করি শয়তানের প্রতি। আমরা ধরেই নিই সে এক পাপ পুরুষ। পাপ আর শয়তান যেন সমার্থক আমাদের কাছে। এই পৃথিবীর যা কিছু মন্দ, যা কিছু খারাপ সবকিছুই ওই শয়তানের দান। সে সারাক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, আমাদের প্রলোভিত করে আমাদের দিয়ে খারাপ কাজ, অন্যায় কাজ করিয়ে নেওয়ার। আসলে একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে মানুষকে সুশিক্ষা দেওয়ার জন্যই পৃথিবীর সর্বত্র এই দুটি শব্দকে উপমা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ভগবান বা শয়তান, এই দুয়েরই উৎপত্তিস্থল আমাদের ভাবনায়, আমাদের চেতনায়। বাইরের কোনো জায়গাতেই ভগবান বা শয়তানের, দুইয়ের কারোরই কোনো অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব আমাদের মনে। 
এই মনেই আমরা গড়ে তুলি ভগবানের অনুপম মূর্তি, প্রাণ সঞ্চার করি তাতে, তাকে অনুভব করি অন্তরের একেবারে কাছে, আমাদের সমগ্র অস্তিত্বের মধ্যে। আমাদের সুখ- দুঃখ, হাসি- কান্নায় সে যেন মিলেমিশে এক হয়ে যায়। আর ঠিক এর বিপরীতেই অবস্থান করে শয়তান। আমরা  সভয়ে, ঘৃণার সঙ্গে অনেক দূরে রাখার চেষ্টা করি। আসলে এও এক ধরনের পলায়নী মনোবৃত্তি। আমাদেরই করা অন্যায় কাজ, পাপকাজকে স্বীকার না করে, সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস না পেয়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা। আসলে আমরা সব সময়ই এস্কেপ গেট খোঁজার চেষ্টা করি, যাতে নিজের পাপ কাজের দায় তার উপর চাপাতে পারি! আমাদের মনের মধ্যেই সুপ্রবৃত্তি আর কুপ্রবৃত্তি একেবারে পাশাপাশি বাস করে এবং তারা নিরন্তর চেষ্টা  চালিয়ে যায় তাদের মত করে আমাদের কাজকর্মকে চালনা করার, আর এইখানেই আমাদের সঠিক যুক্তি, ভাবনা ও চেতনার উপর নির্ভর করেই আমাদের কি করা উচিত আর কি করা উচিত  নয়, তা স্থির করতে হবে। যখন আমরা বুঝতে পারবো যে এই পৃথিবীকে ভালোবাসা এবং চারপাশের মানুষের প্রতি  ভালোবাসা ও উপকারের মনোভাবই আমাদের সৎ পথে চালিত করতে পারবে, সেই দিন আমাদের মনের কোথাও শয়তান নামক মিথের অস্তিত্ব থাকবে না। আমরা সবাই সত্য ও সুন্দরের পূজারী হয়ে উঠবো আর পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যখন পৃথিবীকে ভালবাসবে, তখন এই পৃথিবী বসবাসের জন্য আরও আদর্শ, সুন্দর ও মনোরম হয়ে উঠবে। আমরা সবাই মিলে আমাদের এই পৃথিবীর কষ্ট দূর করতে পারব। আর চোখের জল  মুছিয়ে দিতে পারবো আমাদের কাজের মধ্যে দিয়ে আর এই ভাবেই সার্থক হয়ে উঠবে স্থায়ী বিশ্বশান্তি, যা আমাদের প্রত্যেককে সেই পথের সন্ধান দেবে যে পথে হেঁটে আমরা পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ হয়ে উঠব পরস্পরের প্রকৃত বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী।
আর্থ মানে আমার কাছে আর্নেস্ট আফেকশন অফ রিভিলিং ট্রুথ এন্ড অনেস্টি। অর্থাৎ পৃথিবী মানে আমার কাছে পরম স্নেহময়ী, যে তার সীমাহীন ভালোবাসা দিয়ে পরম সত্য ও সততাকে প্রকাশ করে। এটা একমাত্র প্রকাশ করতে পারে এই পৃথিবী। তার কাছে সবটাই সত্য এবং সৎ ভালোবাসা। তাই পৃথিবীতে শয়তানের কোন অস্তিত্ব বাস্তবে থাকতেই পারে না। যা আছে তা আমাদের কিছু ভ্রান্ত সংস্কার ও ভুল শিক্ষা। যা কিছু সত্য, যা কিছু ভালো, যা কিছু সুন্দর একমাত্র সেটাই ধারণ করে এই পৃথিবী। আমাদের মনের ‘কু’কে আমরা চিরদিনের মত দূর করে দিতে পারব। পৃথিবীর প্রতি আমাদের ভালোবাসার দ্বারা। আর তখনই সেই পরম স্নেহময়ী পৃথিবীর সীমাহীন ভালোবাসা ও পরম সত্য ও সততার প্রকাশকে আমরা অন্তরে অনুভব করতে পারব।