এই পৃথিবীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিচারে এবং সামরিক শক্তির বিচারে কিছু দেশ বা বলা ভাল কয়েকটি দেশ নিজেদেরকে এই পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী দেশ বলে অহংকার করে এবং অন্যদের স্বাধীনতা ও শক্তিকে খর্ব করতে চায়। তাদের চোখ ধাঁধানো আর্থিক প্রাচুর্যই এই অহংকারী ও দাম্ভিক মনোভাবের কারণ। কিন্তু কখনোই তাদের এই কথাটা একবারও মনে আসেনা, যে বিপুল সম্পদ তারা ভোগ করছে সেই সম্পদের একটি কানাকড়িও তাদের নয়। সবটাই এই পৃথিবীর দান। এই পৃথিবী দয়া করে এই সম্পদ তাদের ভোগ আর উপভোগ করতে দিয়েছে বলেই আজ তাদের এত রমরমা। মঙ্গল গ্রহ বা অন্য কোন গ্রহ থেকে এই সম্পদের অতি ক্ষুদ্র অংশও আসেনি। আর ঠিক এই ভাবেই সব দেশই পৃথিবীর এই দান উপভোগ করে। হতে পারে কোন দেশের খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও তেলের সম্ভার হয়তো অন্য দেশের থেকে অনেক বেশি। আর এই যে এত বেশি পরিমাণ সম্পদ সেই দেশ ভোগ করে, সেই সঙ্গে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ সারা বিশ্বে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক অর্থ উপার্জন করে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় সব সময় একটা সুন্দর ভারসাম্য থাকে। এই যে সমস্তটুকুই হয় সে তো এই পৃথিবীর জন্য। অহংকারী বা উদ্ধত না হয়ে, এই পৃথিবীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত কারণ তার এই দান যদি বিপুলভাবে সেই দেশের প্রকৃতিতে, মাটিতে, পাহাড়ে, জঙ্গলে, সমুদ্রে ছড়িয়ে না থাকতো তাহলে সেই দেশের মানুষের এত আর্থিক স্বচ্ছলতা কিছুতেই আসতো না! অন্য অনেক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশের সঙ্গে তাদের তো কোন তফাৎ থাকত না। জঙ্গল, মাটি, সমুদ্র, পাহাড়, নদী- এসব তো সব দেশেই একইরকম। একই রূপ তাদের। তফাৎ শুধু যে সম্পদ রাশি পৃথিবী লুকিয়ে রেখে দেয় প্রকৃতির বুকের ভেতর। যখন সেই দেশের সব মানুষ অনুভব করবে, তারা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান কারণ এই পৃথিবী-মা তাদের অকৃপণভাবে সমস্ত সম্পদ উজাড় করে দিয়েছে, আর তাদেরকে অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তারা যখন এতটাই আনন্দে আছে, তখন ঔদ্ধত্য, অহংকার দেখানো উচিত নয়, বরং তাদের থেকে অনেক কম আর্থিক ক্ষমতা সম্পন্ন দেশের মানুষকে যদি তারা আর্থিক বা নানা দিক দিয়ে সাহায্য করতে পারে তাহলে সেই দেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষও আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হতে পারে, তারাও উন্নত মানের জীবন যাপন করতে পারে এবং সেই দেশের মানুষের প্রতি তাদের একটা ভালোবাসা তৈরি হবে। তারাও অনুভব করবে, তারা একা নয়। তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সহমর্মী বন্ধু আছে। এই চেতনা যখন সেই উপকৃত দেশের মানুষের মধ্যে জাগ্রত হবে, তখন তারাও আবার তাদের থেকে পিছিয়ে পড়া দেশের মানুষকে একই ভাবে সাহায্য করার জন্য উদ্যোগী হবে। আসলে, তখন এই কথা তাদের মধ্যে গেঁথে যাবে যে সবাই ভালো থাকলে, আনন্দে থাকলে, তবেই বেঁচে থাকার আনন্দ সার্থক হয়। এই চেতনা মানুষের মনে যখন জায়গা করে নেবে তখন বিশ্বব্যাপী স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাব আমরা।
সামরিক খাতে এক বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয় প্রত্যেকটি দেশে। ধনীতম দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশ বা দরিদ্র দেশ, যাই হোক না কেন, প্রত্যেক দেশ যখন প্রতিবছর তাদের অভ্যন্তরীণ বাজেট তৈরি করে তখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ,কৃষি ও দরিদ্রদের বাসস্থান নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করে, তার থেকে অনেক বেশি অর্থ বরাদ্দ করে সামরিক ও প্রতিরক্ষাখাতে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল যে দেশ তারা অধিক শক্তিশালী দেশের শাসানি ও হুমকির ভয়ে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ করে, আর অপেক্ষাকৃত ধনী ও সামরিক বলে বলিয়ান দেশ তার তুলনায় দুর্বল দেশকে ভয় পাওয়ানোর জন্য বেশি করে অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্র, অতি উন্নত ও অতি অল্প সময়ে চরম আঘাত হানতে সক্ষম যুদ্ধবিমান ইত্যাদি সংগ্রহ করতেই থাকে। অতি ধনী ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশের অর্থনৈতিক মান ও জীবনযাত্রায় হয়তো এতে খুব বেশি ফারাক পড়ে না, কিন্তু দুর্বল ও উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এর ফল হয় মারাত্মক। যে যে খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ালে দেশের মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার মান উন্নত হতে পারত এবং দেশ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের পথে এগিয়ে যেতে পারত, এর ফলে তা আর হয় না। প্রায় প্রতি বছরই বিশ্বের কোন না কোন জায়গায় মারণ রোগের ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয় আর লক্ষ লক্ষ প্রাণহানিও ঘটে এই কারণে। হাতের কাছে তার অতি জ্বলন্ত এক উদাহরণ করোনা বা কোভিড -১৯ ভাইরাস। এই বিশ্বের ধনীতম দেশ হোক বা দরিদ্রতম দেশ করোনা কিন্তু স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর চূড়ান্ত দুর্বল দিকটা দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ, স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বরাদ্দ অনেক বেশি বাড়িয়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে মজবুত করতে পারলে করোনা হানায় এতোখানি বেহাল দশা হতো না আমাদের। সারা পৃথিবীর সব দেশের আজ এটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। সারাবিশ্ব যে আজ একটা শব্দকে তাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ করে নিয়েছে, সেই লকডাউন ব্যাপারটা আরও অনেক দিন সরকারের তরফ থেকে চালিয়ে যেতে পারতো যদি জনসাধারণের হাতে যথেষ্ট অর্থ থাকতো যে তারা বাড়িতে থেকেও স্বচ্ছন্দে দীর্ঘ কয়েক মাস সংসারের খরচ-খরচা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারত! কিন্তু সেই অবস্থা না থাকার দরুন দৈনন্দিন ভাতা বা মাস মাইনের চাকুরীজীবী অথবা ছোট ব্যবসায়ী, কিছুদিন কাটার পরেই অর্থ রোজগারের তাগিদে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে। যে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে সারা বিশ্বজুড়ে, এই অচলাবস্থা তৈরিই হতে পারবে না আর, যদি সত্যি সত্যিই মানুষের জন্যে, মানুষের কাজে লাগে অর্থ, তাহলে মারণ ভাইরাস এবং দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত চাহিদা পূরণ করা এই দুই দিকই মানুষ সামলাতে পারতো খুব সহজেই।