‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’ অনুসরণ ও যথার্থ প্রয়োগে সমাজে কি আমূল পরিবর্তন ঘটতে পারে, তা নিয়ে আমরা কিছু আলোচনা আগের অধ্যায় করেছি, এবার আরো কয়েকটি বিষয় নিয়ে এই অধ্যায়ে আলোচনা করব। আজকের দিনে জনসংখ্যার চাপ যখন অত্যন্ত বেশি তখন বাড়ির আশপাশে অনেক জমি ফাঁকা রেখে বাড়ি করার বিলাসিতা দেখানো সত্যিই অসম্ভব। আর এই অত্যন্ত ব্যস্ত সময়ে মানুষের হাতে সময় এত কম যে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মাসের পর মাস সময় নিয়ে একটা বাড়ি তৈরি করানোর উপায় সত্যিই আজ মানুষের নেই। এছাড়াও বাড়ি তৈরি করাতে আরো অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ে মন দিতে হয়। তাই আজকের দিনে সবচেয়ে সহজে বাসস্থান পাওয়ার উপায় হল রেডি ফ্ল্যাট। আজকের দিনে বিশাল বিশাল ‘হাউজিং কম্প্লেক্স’ তৈরি হয়েছে সর্বত্রই। আর এই হাউজিং কম্প্লেক্সগুলোতে নানা ধরনের মানুষ বসবাস করেন। অনেক সময়ই দেখা যায় তারা তাদের রুচি, ভাষা, ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস ধর্মীয় আচার-আচরণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে একেবারে বিপরীতমুখী। তাই তাদের মধ্যে কোন আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়না! আর তাই অত্যন্ত শীতল একটা সম্পর্কের বাতাবরণের মধ্যে তারা বসবাস করে। আর নানা রকম বিরোধ বা সমস্যাও তৈরি হয়ে যায় তাদের মধ্যে। আর ঠিক এইখানেই ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’র ম্যাজিক কাজ করে। কেমন ভাবে? এই হাউজিং এর আটশো, হাজার বা দু’হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটটাই একটা পরিবারের পৃথিবী হতে পারে না! প্রতিদিনই যেমন কমন করিডোর, কমন লিফট, কমন প্যাসেজ দিয়ে হাউজিং এর মানুষজন যাতায়াত করে- ঠিক তেমনি ভাবেই পরস্পরের মধ্যেও একটা কমন মেন্টাল ফ্যাক্টর কাজ করা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে যদি ওই বিশাল বিশাল হাউজিং এর কয়েক হাজার মানুষ এটা মনে করতে পারে যে এই হাউজিং-এর কোন ভালো-মন্দে তাদের সবার ভূমিকাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই হাউজিং এর রক্ষণাবেক্ষণ, একটা হাউজিং একটা বিশাল পরিবারের মতো। সেই হাউজিং এর যত রাস্তা, পার্ক সবকিছু পরিষ্কার ও সুন্দর রাখার দায়িত্ব সকলেরই। এই বিষয়ে প্রত্যেকেরই সমান সচেতন হওয়া দরকার। এই সচেতনতা এলেই পরস্পরের সাথে মেলামেশা বাড়বে, সামাজিক আদান-প্রদান বাড়বে, মানসিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানও বাড়বে। এর ফলে মানসিক দূরত্ব ঘুচে যাবে এবং প্রত্যেকেরই অন্যের সমস্যাকে তার নিজস্ব সমস্যা বলে মনে হবে। তাতে হাউজিং এর মানুষের মধ্যে একটা ভালোবাসার বন্ধন তৈরী হবে, হাউজিং এর অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানও খুব সহজেই হবে এবং শুধু তাই নয়, বাইরের কোনো সমস্যাও হাউজিং এর নিরাপত্তা ও শান্তি বিঘ্নিত করতে পারবে না। প্রত্যেকেই যখন অনুভব করবে, চারপাশকে সুন্দর, দূষণমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব তারও, তখনই এই পৃথিবীকে সে ভালোবাসতে শুরু করবে ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কতটা জরুরী বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুযায়ী তা মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করবে এবং এই বিশাল পৃথিবীর অতি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ এক হাউজিং সোসাইটি থেকেই হাতেখড়ি হবে সেই ভালোবাসার।
একটা কথা প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে পড়ি বা নিউজ চ্যানেলে দেখি অথবা বিভিন্ন মানুষের কথায় বা বক্তৃতায় শুনি- সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। শুধু এই ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই এই কথাটা কম বেশী প্রচলিত আছে। আমার কিন্তু একটা কথা ভীষণ ভাবে মনে হয়। এই ‘সংখ্যালঘু’ কথাটা আসবে কেন? শুধু লোকসংখ্যার বিচারে একটা দেশে এক ধর্মের লোকের সংখ্যা একটু বেশি আর অন্য এক ধর্মে বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা একটু কম বলে! কেন এমনটা হবে? প্রত্যেকটা ধর্মেরই মূল কথা, অন্য ধর্মের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন আর ধর্ম- মত নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষেরই প্রত্যেক মানুষকে ভালোবাসা।
‘সংখ্যাগুরু’ বা ‘সংখ্যালঘু’ এই কথাগুলোর কি সত্যিই কোন মানে হয়? ধর্ম কথার অর্থ ধারণ করা। ধর্ম কি কি ধারণ করে? মানুষের প্রতি মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান- সবকিছুই ধারণ করে যে কোন ধর্ম। আর সেই সমস্ত ধর্মকেই ধারণ যে করে, সে এই পৃথিবী। আমাদের এই পৃথিবী-মা। তাই এই পৃথিবীকে ভালোবাসলেই এই লঘু-গুরুর ভেদাভেদ মুছে যাবে। কে কোন ধর্মের মানুষ একথা কখনোই মনে আসবে না। শুধু একটা কথাই মনে আসবে, এই পৃথিবীকে ভালোবাসাই পবিত্র ধর্ম। আর থাকবে এই পৃথিবীকে আশ্রয় করেই। এই উপলব্ধি মানুষের মনে এলেই সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু- এই জাতীয় কথা মনেই আসবে না। প্রত্যেক ধর্মের মানুষ তা সংখ্যায় অল্পই হোক বা বেশি, সহাবস্থান করবে শুধু শারীরিক ভাবেই নয়, মানসিক ভাবেও। এই পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসাতেই আপাত অসম্ভব এই ব্যাপার সম্ভব হতে পারে। এই পৃথিবী কখনো কোন মানুষকে তার ধর্ম, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় নিয়ে কোন প্রশ্ন করেনা বা কোন বিশেষ ধর্মের মানুষের প্রতি কোন বিশেষ পক্ষপাতিত্ব করে না। তার কাছে মানুষের একমাত্র পরিচয় সে মানুষ। আর পৃথিবীকে ভালবাসলে এই পৃথিবীতে পাশাপাশি বাস করবে যারা তারা এক ধর্ম, এক সম্প্রদায়, এক গোষ্ঠীভুক্তমানুষ। তারা এই পৃথিবীর সন্তান।
নগর। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। আর সেই নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার এক একটি একক একজন মানুষ। অর্থাৎ নাগরিক। শহর বা নগরে বাস করা একজন মানুষ। যদি নাগরিকের সংজ্ঞা এটাই হয়, তাহলে একজন গ্রামের মানুষ গ্রামীক, রাজ্যের মানুষ রাজ্যিক বা দেশের মানুষ কি দেশিক বলে অভিহিত হবে? তা তো নয়; তা যদি না হয়, তাহলে যে পৃথিবীতে বাস করি, যে পৃথিবীর উপরেই দাঁড়িয়ে সব দেশ, নিজের ইচ্ছে মত দেশের চারপাশে নানান বাধার সৃষ্টি করে অন্য দেশের থেকে নিজেদের আলাদা করে রেখেছে, তারা কি সত্যিই একেবারে আলাদা করে রাখতে পেরেছে নিজেদের সব দেশের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে?তা যদি হয় তাহলে এক দেশের সাথে আর এক দেশের বৈদেশিক, বাণিজ্যিক চুক্তি হয় কেন? কেনই বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে আন্তর্জাতিক উড়ানের ব্যবস্থা আছে? এক দেশ থেকে অন্য দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা পড়তেই বা যায় কেন আর কেনই বা বিদেশে চাকরি করতে যায় মানুষ? এক দেশের মানুষ কি তাহলে সত্যি সত্যিই অন্য দেশের মানুষের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলতে পারে? দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানও তো দেশের বৈদেশিক নীতির মধ্যে পড়ে। তাই যদি হয়, তাহলে এক দেশের নাগরিক অন্য নাগরিককে কেন সন্দেহের চোখে দেখবে আর কেনই বা ঘৃণাই করবে? কেন কোন দেশের নাগরিকের প্রতি প্ররোচনামূলক বা বিদ্বেষমূলক আচরণ করা হবে! এই ধরনের মনোভাব কেন, তা নিয়ে একটু বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন। আমাদের সবার আগে দরকার সেই জ্ঞান অর্জন করা, যে জ্ঞান বলে আমরা কোন অঞ্চলের, কোন রাজ্যের বা কোন দেশের মানুষ সেটা জানার আগে আমাদের একেবারে মনের ভেতরে ঢুকিয়ে নিতে হবে যে আমার জন্ম এই পৃথিবীতে এবং আমি এই পৃথিবীর মানুষ। আচ্ছা, আশ্রমে যারা থাকে তাদের বলা হয় আশ্রমিক। সেই সম্বোধনে একটা সম্ভ্রম জড়িয়ে থাকে। কিন্তু সেই আশ্রমের আশ্রয়স্থলও তো এই পৃথিবী। তাই কোন পবিত্র আশ্রমের বসবাসকারী মানুষ যদি আশ্রমিক হয়, তাহলে এই পৃথিবীর বুকে বাস করা আমরা ‘পৃথিবীক’ হতে পারি কি! এই শব্দটা নেহাতই আমার মস্তিষ্কপ্রসূত, তাই এই শব্দটা আপনারা হেসে সাদরে গ্রহণ করবেন, না বিরক্তিতে নাক কুঁচকে বর্জন করবেন, সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ স্বাধীনতা আপনাদেরই রয়েছে, তবে একটা শব্দ আপনাদেরকে গ্রহণ করতেই হবে, সেই শব্দটা হল- মানবিক। আর একজন মানবিক হবে তখনই যখন সে আর একজনের দিকে শুধুমাত্র অন্য দেশের মানুষ বলে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাবে না। আর এই মানবিকতা সে অর্জন করবে তখনই, যখন সে সুনিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করবে, সবকিছুর আগে সে একজন পৃথিবীবাসী। তারপর সে কোন এক দেশের নাগরিক। সারা পৃথিবী জোড়া যে বিশাল ভূখণ্ড, তাকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আলাদা করার চেষ্টা করে গেছি আমরাই। কিন্তু অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে এই কাঁটাতারের বেড়া কখনোই কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। না জলে, না স্থলে। পরিযায়ী পাখিরা হাজার হাজার কিলোমিটার উড়ে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে চলে যায় আবার ফিরে যায় তাদের পুরনো ঠিকানায়। জলের স্রোতে ভর করে জলচর প্রাণীরাও চলে যায় কত দূরে! এই মহাপৃথিবীতে তাদের একটাই ঠিকানা, তারা এই মহাপৃথিবীরই প্রাণী। মনুষ্যত্বের প্রাণী যারা, তারা জন্মানোর সঙ্গে এই বোধ, এই সংস্কার সঙ্গে নিয়েই জন্মায়। তাদের বোঝানোর জন্য প্রকৃতির নিজের পাঠশালাই যথেষ্ট, যেখানে প্রকৃতিই তাদের শিখিয়ে দেয় এই পৃথিবীই তাদের ঠিকানা, এই পৃথিবীই সুখে, দুঃখে, স্নেহে, ভালোবাসায় তাদের বুকে জড়িয়ে রেখেছে। এই পৃথিবীই তাদের পরম ভরসাস্থল। আমরা তো আমাদের নানা আমোদ-প্রমোদ আর শখের জন্য নিরীহ পশুপাখিদের ধরে এনে বাড়িতে রাখি, প্রাইভেট সার্কাস তৈরি করি নিজেদের অহং চরিতার্থ করার জন্য; এমনকি বাঘ, সিংহের মত প্রাণীকে ধরে এনে নানা নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে তাদের উপর অ-মানুষিক, না-না, নিতান্তই মানসিক অত্যাচার চালিয়ে তাদের বশ করার চেষ্টা করি। অমানুষিক বা পাশবিক আচরণ বলতে মানুষ নয়, এমন কোন প্রাণীর আচরণ বোঝায়; কিন্তু মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী অন্যায়, নিষ্ঠুর, নির্যাতন করে নিজের আয়ত্তে রাখতে চেয়েছে অন্য কোন প্রাণীকে,পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত এমন উদাহরণ একটাও নেই। তারা বিশ্বাস করে এই পৃথিবী তাদের সবার আর তাই যেখানে খুশি যাওয়ার, যেখানে খুশি থাকার, স্বাধীনভাবে ইচ্ছে মত থাকার অধিকার সব প্রাণীর আছে। আমরা, আমাদের আনন্দ হবে বলে, দশজনকে ডেকে গর্ব করে বলা যাবে বলে আমরা আমাদের অনেক অনেক অভ্যাস তাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি, অনেক কিছুই শেখানোর চেষ্টা করি। এত কিছুর বিনিময়ে আমরা যদি একটা মাত্র শিক্ষা তাদের থেকে অর্জন করি যে আমরা সবাই এই পৃথিবীবাসী আর আমাদের সর্বপ্রথম পরিচয় আমরা বিশ্ব নাগরিক, তাহলেই এক অখণ্ড নাগরিকত্ব আমরা অর্জন করব, কেউ কারোর নাগরিকত্ব নিয়ে সন্ধিহান হবো না, তাকে অবাঞ্চিত মনে করব না।
শুধু এইটুকু উপলব্ধি যদি আমাদের মনে আসে যে এই পৃথিবী যেমন কারোর জন্মস্থান, সে কোন জাতি, বর্ন বা ধর্মের মানুষ সেই সমস্ত হিসেব করে তার ভালোবাসা উজাড় করে দেয় না, আর শুধু মানুষ নয়, এই পৃথিবীতে যা কিছু প্রাণী আছে, সবাই একইভাবে জল, আলো, বাতাস পায়। মানুষের মধ্যে সৎ, অসৎ সব রকম মানুষ আছে। সেই অনুযায়ী আমরা তাদের সঙ্গে আমাদের আচরণের মাপকাঠি ঠিক করি। এই পৃথিবী কিন্তু কোনো আগ্রহই দেখায় না এইরকম ব্যাপার নিয়ে; সে সমান গুরুত্ব, সমান ভালোবাসা, সমান মর্যাদা দেয় প্রত্যেকটি মানুষকে আর নীরবে হয়তো অতি সরব বার্তা দেয় মানুষকে যে, পৃথিবীর মানুষ যদি পৃথিবীর মতো করে সব মানুষকে ভালোবাসতে, গুরুত্ব ও মর্যাদা দিতে পারে, তাহলে কোন দেশের সীমান্তে ,যা আসলে এই পৃথিবীর ছোট্ট একটা ভূখণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়, সেই সীমান্তে দাঁড়িয়ে এক ভূখণ্ডবাসী, আর এক ভূখন্ডবাসীকে চোখ রাঙিয়ে, কড়া গলায় তার নাগরিকত্বের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করবে না, কারণ তখন উভয়ই জানে যে তারা অতি বৈধ পৃথিবীবাসী আর সেই বৈধতা প্রকাশিত ও প্রমাণিত হয় বাই দি পাসপোর্ট অফ লাভ, ইস্যুড বাই মাদার আর্থ।