।। দ্বিতীয় অধ্যায়।।

‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’ কে আমরা চারটি স্তরে ভাগ করতে পারি অর্থাৎ চারভাবে এবং কার্যকরীভাবে আমরা এই ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’ কে আমরা প্রয়োগ করতে পারি আমাদের জীবনে। ভাবতে ভাবতে আমার মনে হল এই ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’ এই সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে। কিভাবে সম্ভব এটা? সেটাই আলোচনা করবো এই অধ্যায়ে। আমরা এই ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’কে প্রথমেই একেবারে স্থানীয় স্তরে কার্যকর করে তুলতে পারি। কারণ কথাতেই তো আছে- চ্যারিটি বিগিনস্ অ্যাট হোম, তাই এই বিশ্বশান্তি সূত্রকে প্রাথমিক স্তর থেকেই কার্যকর করে তুলতে পারি। যদি এই সূত্রকে ঠিকমতো অনুসরণ করতে পারি, নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে নিতে পারি, তাহলে সত্যি সত্যিই আমাদের ঘরের ছোট ছোট সমস্যাও একটু একটু করে মিটে যাবে। এই সমস্যাগুলোর অন্যতম হলো পারিবারিক দ্বন্দ্ব। খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এই পারিবারিক দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং একটা সময় এমন বিশাল আকার ধারণ করে যে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কিন্তু এই কথা যদি আমরা অন্তর থেকে অনুভব করতে পারি যে শান্তির প্রথম ধাপ হলো পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা। যদি পৃথিবীকে ভালোবাসা যায়, তাকে আত্মার আত্মীয় মনে হয়, তাহলে অনেক সু-অভ্যাস আপনা থেকেই তৈরি হয়ে যায়! একবার যদি আমরা অনুভব করতে পারি কি অসীম ধৈর্য নিয়ে কোটি কোটি বছর ধরে এই পৃথিবী ধারণ করে আছে, তাহলে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, আবেগে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠবে। আপনা থেকেই চোখ জলে ভরে যাবে, বন্ধ হয়ে যাবে মুখের কথা! শুধু চুপ করে বোসে একটা কথাই ভাবতে হবে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমনকি মৃত্যুর পরেও এই বিপুল প্রাণিজগতের ভারবহন করে এই পৃথিবী। উজাড় করে দিয়েছে যাবতীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ ও বিপুল প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার। আমরা নিঃশেষে শোষণ করেছি, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছি তার সমস্ত উপহার, আর তারপরেও নিজেদের সীমাহীন লালসা চরিতার্থ করার জন্য ধ্বংস করে চলেছি যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্য। 
এ বড় লজ্জার, আর এই লজ্জা সম্পূর্ণভাবে আমাদের। এই মানুষ নামক অতি উন্নত, অতি বুদ্ধিমান, অতি সভ্য প্রাণীদের। মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী পৃথিবীর কোন ক্ষতি কক্ষনো করে না। যেটুকু তাদের প্রাণ ধারণের জন্য প্রয়োজন ততটুকুই তারা এই পৃথিবী থেকে আহরণ করে। আবার তাদের সাধ্যমতো সেইটুকুও ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। একটা ছোট পাখি ফলের বীজ বহন করে নিয়ে যায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। তার বহন করা বীজ থেকেই জন্মায় নতুন চারা। পৃথিবী সবুজায়নের দিকে আরেকটুখানি এগিয়ে যায়! কই সেকথা ওই ছোট্ট পাখিকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বোঝাতে হয় না, অথচ আমাদের বোঝাতে হয়; অথচ সৃষ্টিকর্তার দয়ায় আর পৃথিবী-মায়ের আশীর্বাদে আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী! পৃথিবীর ধৈর্যের কোটি-কোটি ভাগের এক ভাগও যদি আমরা অর্জন করতে পারি, তাহলেই পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা ও সহানুভূতি আমরা দেখাতে পারব। ভালোবাসার নিবিড় মোড়কে ঢাকা পড়ে যাবে হিংসা, ঈর্ষার মত কু-অনুভূতি! কঠোর গম্ভীর মুখের কঠিন সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবে স্বচ্ছ হাসির সুন্দর আধারে। ঠিক এইভাবেই প্রতিবেশীদের সঙ্গেও তৈরি হবে ভালোতে বাস করার সম্পর্ক, যা, যে কোনো মন্দবাসাকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করবে। মানসিক উদারতা আর ভালোবাসা যখন বাড়বে তখন প্রতিবেশীদের কোন অসুবিধে হোক আমাদের দ্বারা, একথা আমাদের মনে কখনোই আসবে না। নিজের চারপাশ পরিষ্কার রাখতে, চারপাশ যাতে দূষণমুক্ত থাকে তা খেয়াল রাখতে আমরা নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখবো। এর ফলে আমাদের চারপাশের মানুষের সাথে একটা আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হবে। বাড়ির ও বাড়ির আশেপাশে প্রাকৃতিক পরিবেশ যখন নির্মল হবে, তখন তা ছাপ ফেলবে আমাদের মনে, শান্তির বাতাবরণ তৈরি হবে চারপাশ ঘিরে আর সামাজিক মূল্যবোধ কথাটা শুধু বইয়ের পাতায়, বিভিন্ন সেমিনার, বক্তৃতা আর খবরের কাগজের ব্যাকুল হেডলাইন হয়ে থাকবে না। ঐ কথাটাই হয়ে উঠবে এই সমাজের হার্টলাইন আর তখনই শুরু হবে ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’এর সফল রূপায়ণ।
এইবারে আমি আসবো দ্বিতীয় ধাপে। রাজ্য, প্রভিন্স বা স্টেট জুড়ে ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’ -এর প্রয়োগ ও কার্যকারিতা প্রসঙ্গে। যখন আমাদের বাড়ি, বাড়ির চারপাশের পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে এই সূত্রের সফল প্রয়োগ আমরা দেখতে পাবো, আপাত তুচ্ছ অত্যন্ত জরুরী কিছু অভ্যাস আমাদের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে অত্যন্ত অনায়াসেই। যেমন- রাস্তার পাশে আবর্জনা ফেলে নোংরা করা। এটা কখনোই আমরা আর করব না। কারণ তখন আমরা উপলব্ধি করবো, যে বাড়িতে আমরা থাকি, সেই বাড়িটাকেই শুধুমাত্র পরিষ্কার রাখলে হবে না, অতি বৃহৎ যে পৃথিবী-বাড়ির আমরা ‘রেন্টলেস টেন্যান্ট’ বা ভাড়া-বিহীন ভাড়াটিয়া, সেই পৃথিবী-বাড়ির শুধু দখলদার হলেই চলবে না, তার সঠিকভাবে ‘টেক কেয়ার’ও করতে হবে। আর টেক কেয়ার করার প্রাথমিক শর্ত হল আমাদের চারপাশকে আরো একটা বিষয়েও সতর্ক হতে হবে। সেটা হলো জল- সম্পদ বাঁচানো। অনেক সময়েই দেখা যায়, রাস্তার কল থেকে জল নেওয়ার পর মানুষ সেই কলের জল পড়া বন্ধ করার কষ্টটুকুও স্বীকার করতে চায় না। এ বড় ভয়ঙ্কর প্রবণতা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়- ও আর কতটুকু জল পড়ছে! কিন্তু এই অজ্ঞতার জন্য জলস্তর ভয়ংকরভাবে কমে গিয়ে এক মারাত্মক বিপদের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। এই অপচয় এক্ষুনি বন্ধ করতে না পারলে সেই দিন একেবারেই দূরে নেই, যেদিন পৃথিবী-মায়ের স্নেহের প্রবল ধারা আমাদের প্রতি একইভাবে বর্ষিত হবে, কিন্তু তার বুকের জলের ধারা শুকিয়ে যাবে। ‘জলই জীবন’ এই মহৎ বাক্যকে আমাদেরই হঠকারিতায় একেবারে ব্যর্থ করে দিয়ে ‘জলহীন মরণ’এর কঠিনতম পুরস্কার লাভ করবো আমরা। যে খাদ্যই গ্রহণ করুক না কেন, তার পানীয় জলের প্রয়োজন হয়। পৃথিবী-মায়ের সর্ব জীবের প্রতি সমদৃষ্টির এক অতি আশ্চর্য উদাহরণ! যে কোন মানুষ সে যত গুরুতর আহত অবস্থায় থাকুক না কেন, প্রথমেই তার মুখ দিয়ে যে কথাটা বের হয় তা হল- জল। কঠোর পরিশ্রমে ক্লান্ত কোন মানুষ কিংবা নানা রকম সুখাদ্য খেয়ে পরিতৃপ্ত কোন মানুষ- দু’জনেই কিন্তু চায়, এক গ্লাস জল, যা একজনের তৃষ্ণা মিটিয়ে তার ক্লান্তি দূর করবে, আর একজনের খাদ্য গ্রহণের তৃপ্তিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবে; সেই জল যদি আর না পাওয়া যায়, যেটুকু জল থাকবে তা অতি দূষণে যদি পানের অযোগ্য হয়ে যায় অথবা জলের ভাণ্ডার অপ্রতুল হয়ে পড়ে- তখন একজন মানুষের কাছে যদি পৃথিবীর যাবতীয় অর্থ থাকে অথবা পৃথিবীর যাবতীয় সুখাদ্য প্লেটে করে তার সামনে সাজিয়ে দেওয়া হয়, অতি সেই প্রথম মানুষটি পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ আঁকড়ে ধরে অথবা দ্বিতীয় মানুষটি যাবতীয় সুখাদ্য খেয়েও কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারবে না, যদি তারা পানীয় জলটুকু না পায়। আর্থিক অবস্থার ফারাকের জন্য কেউ একজন অতি উৎকৃষ্ট খাবার খেতে পাবে আবার কেউ অতি সাধারণ খাবার খেতে পারে, কিন্তু দু’জনেরই প্রয়োজন পানীয় জলের। আর ঠিক এই কারণেই ‘দ্যা আর্থ ইজ দি গ্রেটেস্ট লেভেলার’। পৃথিবীর কাছে ধনীতম ব্যক্তি বা দরিদ্রতম ব্যক্তির মধ্যে কোন তফাৎ নেই। বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুবিধাটুকু সে সকল মানুষকেই সমানভাবে দেয় আবার মানুষ যখন মৃত্যুর পর মাটিতে মিশে যায় তখনো সেই ‘গ্রেটেস্ট  লেভেলারের’ দায়িত্বই পালন করে সে। তখনো মাটিতে মিশে যাওয়া ধূলিকণার কোনোটায় ধনী বা কোনোটায় গরীব বলে কোন বোর্ড লাগানো থাকে না! এক মুঠো ধুলো হাতে তুলে দেখা যায় তারা মিলেমিশে অবিকল এক। হাত থেকে ফেলে দিলে সবই আবার একসাথে মাটিতে মিশে যায়। কোন ধূলিকণাই পৃথিবীর কাছে আলাদা অ্যাডভান্টেজ পায় না। 
তাই যদি এই ভাবেই একটু সচেতন হয়ে আমরা নানা বিষয়ে অপচয় বন্ধ করতে পারি বিশেষ করে জলের অপচয় যদি বন্ধ করতে পারি, না, যদি নয়, বন্ধ আমাদের করতেই হবে, আর তাহলেই আমাদের স্থানীয় অর্থনীতিতে রীতিমতো প্রভাব পড়বে। জলের খাতে যদি অতিরিক্ত অর্থ-খরচ বন্ধ হয়, যদি উদ্বৃত্ত জল ঠিকভাবে কল-কারখানায় জলের প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায় আর বিশেষ করে কৃষিকাজে যদি অতি প্রয়োজনীয় জলের যোগান সহজ হয়ে যায়, তাহলে কৃষির জন্য অনাবৃষ্টির অভিশাপ থাবা বসাতে পারবে না, মাঠের ফসল জ্বলে পুড়ে নষ্ট হয়ে যাবে না! ফসলের অতিরিক্ত দাম বাড়বে না, লোকের ক্রয় ক্ষমতার উপর চাপ পড়বে না। চাল, ডাল, গম ইত্যাদি অত্যন্ত জরুরি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নাগালের মধ্যে থাকলে, সাধারণ মানুষ কিছু অর্থ সঞ্চয় এবং বিভিন্ন খাতে ব্যয় করতে পারবে আর এই ভাবেই সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ উপকৃত হবে আর ক্রমশঃ সচল অর্থনীতির অংশ হয়ে উঠবে। আর এই ভাবেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে স্থানীয় অর্থনীতি আর উন্নতি হবে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার, কারণ অর্থনীতি একটি গতিশীল ও পরিবর্তনশীল সাবজেক্ট।
ঠিক এই ভাবেই ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’কে দেশের বৃহৎ পটভূমিতে ও ভিন্নতর আঙ্গিকে যদি করা হয়, তাহলে তার সুফল হবে ব্যাপকতর। আমাদের সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থে তৈরি করা বাড়ির যদি একটা ইট খসে যায়, সামান্য একটু রং যদি চটে যায় বা কোন ছোট ছেলের ঢিলের আঘাতে যদি বাড়ির জানালার একটা কাচও ভেঙে যায়, তাহলে আমরা পাগল হয়ে যাই; ঠিক এই ভাবেই এই পৃথিবী ও পৃথিবীর সব সম্পদকে যদি নিজের বলে ভাবতে পারি, তাহলে দেশের জলসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদও অন্যান্য সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ আমরাই করতে পারব আর দেশের অন্যতম শক্তি কৃষিকাজ ও ছোট-বড় অসংখ্য শিল্পোদ্যোগ আমাদের বিশ্বাস ও ভালবাসার ছোঁয়ায় দ্রুত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। যখন আমরা সম্যকভাবে উপলব্ধি করব দেশের আর্থিক উন্নতির দুই স্তম্ভ কৃষি ও শিল্প, এই দুইয়ের চূড়ান্ত উন্নতি হলেই ব্যক্তিগত উন্নতির সূচক ক্রমশঃ উর্ধ্বগামী হবে এবং আমরা প্রত্যেকেই উপকৃত হবো। একমাত্র তখনই আমরা ভালোবাসা, দায়িত্বজ্ঞান ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রত্যেকে উদ্যোগে সামিল হবো কারণ আমরা মনেপ্রাণে তখন বিশ্বাস করবো যে এই পৃথিবী ভালোবাসা, বিশ্বাস ও পবিত্রতার প্রতিমূর্তি। তাই একজন পৃথিবীবাসী হিসেবে, এই পৃথিবী মায়ের এই গুণগুলো আমাদের মধ্যেও প্রতিফলিত হবে, আর এখানেই ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’ এর সার্থকতা।
জাতীয় স্তরকে ছুঁয়ে এবার আসব আন্তর্জাতিক ভাবনায় ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’ আর কার্যকারিতার প্রসঙ্গে। আসলে ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’ অত্যন্ত নমনীয় এক সূত্র, যে সূত্রের মধ্যে সারা পৃথিবীর মানুষের সহাবস্থান শুধু যে অত্যন্ত সহজ, তাই-ই নয় এই পৃথিবীতে মানুষের সুমধুর অস্তিত্বকে মধুরতর করে তোলার জন্য এই ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’কে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে তুলতে হবে। সারা পৃথিবীতে কোন না কোন দেশের সঙ্গে অন্যদেশের প্রতিদিনই যুদ্ধ লেগে আছে। এই দুই দেশের তরফ থেকে এই যুদ্ধের জন্য যা যুক্তি বা কৈফিয়ৎই দেওয়া হোক না কেন এর প্রধানতম কারণগুলো হলো- আগ্রাসী ও অত্যন্ত লোভী মনোভাব, অত্যন্ত অসহিষ্ণুতা ও আমি এবং আমার দেশ বা ধর্মই শ্রেষ্ঠ - এই মনোভাব। মজার কথা হল, যুদ্ধরত কোন দেশ অথবা অন্য দেশের ভূখণ্ড জোর করে দখল করার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা কোন দেশই এই কথাগুলো কিছুতেই স্বীকার করবে না। প্রত্যেক মানুষের কাছে তার যুক্তিই একমাত্র সত্য আর অভ্রান্ত। শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক স্টিফেন লীকক বলেছিলেন- তুমি ছোটবেলায় তোমার ধাত্রী-মা থেকে শুরু করে চারপাশের লোক আর বড় হয়ে তোমার বন্ধুবান্ধব, কাউকে কি যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পেরেছ? তর্কে জিততে পেরেছো? পারোনি- সত্যিই আমরা পারিনা, কারণ ঐ যে বললাম, আমাদের কাছে একমাত্র আমাদের যুক্তিই সঠিক। 
এবারে দেখা যাক, অন্য কোন দেশের বলে স্বীকৃত ভূখণ্ড বা সেই দেশকে দখল করার পরে ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়। প্রত্যেক প্রাণীরই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছে। সে ছোট্ট একটা পাখি থেকে শুরু করে বৃহৎ প্রাণী হাতি, বাঘ বা সিংহ- যেই হোক না কেন! মানুষও একেবারেই ব্যতিক্রম নয়। তার ফলে যে দেশ দখল করা হয়, সেই দেশের অর্থ, প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন লুণ্ঠিত হয়, অত্যাচারিত ও পরাধীন সেই দেশের মানুষ প্রবল আক্রোশে ফুঁসতে থাকে এবং আক্রমণ, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার পালা এবং পাল্টা দমন-পীড়ন নীতি চলতেই থাকে। যুগের পর যুগ, সেই ট্র্যাডিশনই চলছে! এই যে পরস্পরের প্রতি অতি হিংস্র মনোভাব, এই মনোভাবের ফলে প্রচুর প্রাণহানি যেমন ঘটে তেমনি ভাবেই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় উভয় দেশেরই অর্থনীতি। আবার দুই দেশের পরস্পরের প্রতি যুদ্ধের হুঙ্কার আর ছায়াযুদ্ধের বাতাবরণে সেইসব দেশের সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বেড়ে যায় অনেকগুণ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও শিল্প -ইত্যাদি যে অত্যাবশ্যকীয় খাতে ব্যয় বরাদ্দের প্রয়োজন অনেক বেশি, দেখা যায় সেইসব দিকই অবহেলিত হচ্ছে। আর, এই বুঝি যুদ্ধ লাগলো, এইরকম একটা ভয় যখন মানুষের মনে জেঁকে বসে, তখন সাধারণ মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুদ করতে থাকে। এই প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস কেনার জন্য সঞ্চিত অর্থ সে ব্যয় করতে থাকে, আর এই সুযোগে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করে। বিপুল চাপ পড়ে সেই দেশের অর্থনীতির উপরে। ভেঙে পড়ে অর্থনীতি। অথচ সামরিক খাতে ঐ বিপুল ব্যয়, অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনার জন্য সাধ্যের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে একটি দেশ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা বিশ্বব্যাংকের কাছে বিপুল পরিমাণ দেনা করে এবং যে দেশ থেকে অস্ত্র কেনে সেই দেশের কাছেও তার দেনা হয়, কারণ একটি গরিব বা উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে অস্ত্রের বিশাল পরিমাণ দামের সবটুকুই একেবারে মিটিয়ে দেওয়া অনেক সময়েই সম্ভব হয়ে ওঠে না! এর ফলে গোটা দেশ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর একটি দেশের ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ার অর্থ কিন্তু পাহাড়, নদী, সমুদ্র, জল, মাটি, সমস্ত খনিজ,প্রাকৃতিক, গ্যাসীয় সম্পদ সহ প্রত্যেকটি মানুষেরও দেনার দায়ে বাঁধা পড়ে যাওয়া। দেশের মানুষের স্বার্থে কোন বৃহৎ পরিকল্পনা করতে গেলেও কিন্তু ঋণদাতা সেই দেশের সম্মতির অপেক্ষায় থাকতে হয়। প্রত্যেকটি দেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি, পররাষ্ট্র নীতি, সামরিক পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট নীতি থাকে এবং দেশেরই নিরাপত্তার স্বার্থে, সেই নীতি যথেষ্ট গোপনীয় থাকে। দেনার ভারে মাথা নিচু করে থাকা একটি দেশের কিন্তু এই স্বাধীনতা থাকে না। এই দেনা শুধু বর্তমান প্রজন্মেরই তা কিন্তু নয় মোটেই। কয়েক প্রজন্ম ধরেই সেই দেশের মানুষ বহন করে চলে সেই দেনার অভিশাপ। একটি মানব শিশু জন্ম নেয় ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও খনিজ সম্পদের উপরেও থাবা বসায় ঋণদাতা সেই দেশ। অন্য দেশের নিজস্ব নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সক্রিয় ভূমিকা নেয় তারা। এই অসহ্য অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে, ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’। এই সূত্রের নীতি অনুযায়ী কোন দেশ যদি তার অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি যেমন পরিবেশ দূষণ রোধ করা, দরিদ্র মানুষের মাথার উপর ছাদের ব্যবস্থা করা, প্রত্যেক মানুষের মুখের অন্ন জোগানের জন্য অতি বৃহৎ ও সুষ্ঠ পরিকল্পনা করা, শিক্ষাখাতে দেশের বাজেটের বৃহৎ অংশ ব্যয় করা, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা, কারণ একটি দেশের মানুষের স্বাস্থ্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একটি দেশের ‘শিশুস্বাস্থ্য’ সেই দেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অত্যন্ত সংবেদনশীল অঙ্গ। একটি শিশু যদি সঠিক চিকিৎসা, সুষম আহার ও উপযুক্ত শিক্ষা পেয়ে বেড়ে ওঠে, তাহলে সেই শিশু একদিন বড় হয়ে উঠবে, সব অর্থেই প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে এবং দেশকে সমৃদ্ধি, শান্তি ও উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর আগেই বলেছি, এটা একমাত্র সম্ভব, যদি বিশ্বজুড়ে ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’র সফল প্রয়োগ ঘটানো যায়! সূত্রের অর্থ সম্যকভাবে মানুষ উপলব্ধি করলে এবং তার সঠিক প্রয়োগ হলে মানুষ নিজের ঘর, নিজের চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর রাখা, প্রতিবেশীর সাথে আন্তরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা, প্রকৃতিকে দূষণমুক্ত রাখা,জলের উপযুক্ত সংরক্ষণ- ইত্যাদি বিষয়ে এবং শিশুদের উপযুক্ত আহার, শিক্ষা, চিকিৎসা - ইত্যাদি বিষয়ে তখন মানুষ এত বেশি ব্যস্ত থাকবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার জন্য মানুষ দিন-রাতের অধিকাংশ সময়ে ব্যস্ত থাকবে এবং এর ফলে দেশের শিল্প, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য সব বিষয়েই উন্নতি হবে এবং অপর দেশের প্রতি ঘৃণার মনোভাব, হিংস্র মনোভাব — একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। 
প্রত্যেক ধর্মের মানুষ, প্রত্যেক ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধার মনোভাব পোষণ করবে। তার কারণ বিশ্বের যে কোন ধর্মের মূল কথা হলো ভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং প্রত্যেক মানুষকে ভালোবাসা। অতএব মানুষ যদি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অপর মানুষকে ভালোবাসে, তখন আপনা থেকেই মানুষ বুঝতে পারবে, যুগ যুগ ধরে এই যে বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য মানুষ মরীয়া লড়াই চালিয়েছে, ধ্বংস হয়েছে অজস্র ধর্মস্থান এবং প্রচুর প্রাণহানি ঘটেছে- এই ক্ষতি অপূরণীয়। কোন মূল্যেই এই ক্ষতি কেউই পূরণ করতে পারবে না, কিন্তু ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’কে মানুষ যখন অন্তর থেকে গ্রহণ করবে এবং দৈনন্দিন জীবনে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে মনে করে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ করবে জীবনে, তখন মানুষ নিজেই বুঝবে, যে জাত-বর্ণ এবং ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মানুষের এত বড়াই, প্রতিমুহূর্তে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লড়াই এবং এক ধর্মের মানুষের, অন্য ধর্মের প্রতি অবজ্ঞাসূচক মনোভাব- এইসবের কোন কিছুর কোন অস্তিত্ব থাকবে না, যদি এই পৃথিবী আমাদের বসবাসের যোগ্যই না থাকে! আমরা খুব গর্ব করে বলে থাকি, পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন; আমাদের বিবেচনাহীন নির্মম, নিষ্ঠুর কাজের জন্য অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে এই পৃথিবী! অত্যন্ত ভ্রান্ত এক ধারণা! কোটি কোটি বছর ধরে গোটা পৃথিবী জুড়ে চরম বিপর্যয় ঘটেছে বারবার! বিস্ময়কর বদল ঘটেছে প্রাকৃতিক পরিবেশে, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অতি শক্তিশালী প্রাগৈতিহাসিক সব প্রাণী কিন্তু সমস্ত বিপর্যয় অতিক্রম করে, পৃথিবী বারবার নতুন রূপে স্বমহিমায় অটল থেকেছে। 
কখনো কখনো মানুষ বিপুলভাবে প্রচার করতে থাকে অমুক বছরের অমুক দিনে, অমুক সময়ে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ইনফর্মেশন তারা কোথায় পায় এটা ভেবে আমি বেশ অবাক হই কারণ পৃথিবী নিজের মুখে বা আচরণে কোন  ডিক্লারেশন দেয় আমার তো জানা নেই। দৈববাণীর মত পৃথিবীবাণীও কি কেউ কেউ শুনে ফেলে! আমি জানিনা। আর চমক এবং হুজুগের নেশায় অন্ধ মানুষ একবারও এটা ভেবে দেখেনা, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলে সে যাবে কোথায়? চাঁদ, মঙ্গলগ্রহ না অন্য কোনো গ্রহে সবাই মিলে চলে যাওয়ার উপায় তো এখনও আবিষ্কৃত হয়নি! পৃথিবী নিজের মতই আছে আর নিজের মতই থাকবে এই কথাটাই আমরা ভুলে যাই। এইজন্যই সে পরম আশ্চর্যময়ী আর রহস্যময়ী তাই যত এই ধরনের প্রচার হয়েছে, ততই আরও অনেক অনেক ঐশ্বর্যময়ী হয়ে সে মেলে ধরেছে নিজেকে। তার বুকের উপর দিয়ে হেঁটেই মানব সভ্যতার উত্তরণ ঘটেছে, আর যত উত্তরণ ঘটেছে, ততই সভ্য মানুষ অ-সভ্য, বর্বর আচরণ করেছে। কোন বীভৎস দৃশ্য দেখলেই আমরা বলি- কী নৃশংস, পাশবিক কান্ড! আমরা কখনোই একথা ভেবে দেখি না যে পশুরা যে আচরণ করে তা তাদের প্রকৃতির কারণেই করে। এই পৃথিবী-মা তাদের প্রকৃত অর্থেই মা! প্রকৃতির কোলে তারা জন্মায়, সেই প্রকৃতির কোলেই তারা বড় হয়, বেঁচে থাকে, আবার প্রকৃতির কোলেই মৃত্যুবরণ কোরে প্রকৃতির কোলেই মিশে যায়। তারা জোর করে এসে কখনোই কোনো মানুষের খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থানে থাবা বসায় নি, তাদের নির্মমভাবে বাস্তুচ্যুত করার কথা ভাবেনি, শুধুমাত্র শখ মেটানোর জন্য অথবা চরম লোভ- লালসা চরিতার্থ করার জন্য আচমকা হানা দিয়ে নির্বিচারে তাদের হত্যা করেনি, করেনা! অথচ মানুষ এর প্রত্যেকটি করে চলেছে, যেদিন অ-সভ্য বনমানুষ ছিল সেই দিন থেকে আজ পরম সুসভ্য মানুষে পরিণত হওয়ার পরেও। তবে সেই দিনের সঙ্গে আজকের একটা সুস্পষ্ট তফাৎ রয়েছে। সেদিন সেই মানুষগুলো পেটের খিদে মেটানোর জন্য পশুপাখি হত্যা করত আর হিংস্র জানোয়ারের সাথে লড়াই করে প্রতিমুহূর্তে টিকিয়ে রাখতো তাদের অস্তিত্ব। আজও পৃথিবীর কাছে সব প্রাণীই সমান। মানব সভ্যতা যেদিন থেকে উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছতে শুরু করলো সেই দিন থেকেই অত্যন্ত কুৎসিত কিছু বিষয়কে সে নিজের অভ্যেসে পরিণত করে ফেলল। অত্যন্ত নিরীহ প্রাণী থেকে শুরু করে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার শিকার করা হয়ে দাঁড়ায় আমোদ-প্রমোদের বিষয় এবং গর্ব-ঔদ্ধত্য ও অহংকারের প্রতীক। পৃথিবীকে ভালোবাসতে পারলে এই ধরনের মনোবৃত্তি ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকে চলে যাবে, যখন মানুষ নিজেই উপলব্ধি করবে সুন্দর পৃথিবীতে যেমন মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তার স্বাধীনতা আছে, সুন্দর পৃথিবীকে আর তার পরম সুন্দর সৃষ্টিকে উপভোগ করার অধিকার আছে, তেমনি একটা ছোট্ট পাখি বা প্রজাপতিরও বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। মানুষের মতোই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমনকি মৃত্যুর পরেও এই পৃথিবীই তাদেরও একমাত্র ও শেষ আশ্রয়স্থান। এইভাবে চেতনা জাগ্রত হলেই মানুষ একক ও সামগ্রিকভাবে নিজের চারপাশ, অঞ্চল, নিজের রাজ্য ও নিজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির দিকে নজর দেবে। এই ভাবেই সব দেশের মানুষ যখন নিজের দেশের কথাই ভাববে, তখনই প্রকৃত অর্থে দেশের সেবা করা হবে, আর আমি মনে করি দেশের সেবা করা মানেই পৃথিবীর সেবা করা।