অস্ট্রেলিয়ার সিডনির এই ভাড়াবাড়িতে আমি কিছুদিন হলো এসে উঠেছি। প্রতিদিন একটু একটু করে খাপ খাইয়ে নিচ্ছি চারপাশের সঙ্গে। এই বাড়িটার মধ্যে আমার খুব প্রিয় জায়গা ছোট্ট ব্যালকনিটা। ঘন্টার পর ঘন্টা ঘাড় গুঁজে কাজ করার পর ফিরে এসে ক্লান্ত আমি, নিজের হাতে এক কাপ কফি বানিয়ে যখন এই ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই, তখন গরম কফির সাথে চুমুকে চুমুকে আমার সারাদিনের ক্লান্তিকেও আমি গিলে ফেলি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনই দেখি, অনেক দূরে আকাশটা কেমন যেন মাটির সাথে মিলেমিশে এক হয়ে যায়। প্রতিদিনই দেখি আর প্রতিদিনই আমার মনে হয়, এই যে আকাশ- মাটি মিলেমিশে এক হয়ে যায়, এর পেছনে এদের কি কোন স্বার্থ আছে অথবা কোন চুক্তি! মনে হয়, না! অথচ দু’জন মানুষ, দু’টো কোম্পানি অথবা দু’টো দেশ পরস্পরের সাথে প্রতিনিয়ত চুক্তি বা শর্তে আবদ্ধ হচ্ছে। তা লিখিতই হোক বা অলিখিত। কিন্তু এই যে আকাশ- মাটির মিলন তাতে না আছে কোন শর্ত, না আছে কোন চুক্তি। তাই তাদের মধ্যে না হয় কোন চুক্তিভঙ্গ বা ব্রীচ অফ্ কনট্রাক্ট আর না থাকে তাদের মধ্যে শর্তভঙ্গের বেদনা বা চুক্তিভঙ্গের শাস্তি! রোজকারের মতো এইসব কথা ভাবতে ভাবতে আজ আমার মনে একটু চিন্তা এলো! আমাদের এই পৃথিবী তার নদী, পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র আর অজস্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিপুল খনিজ সম্পদ আর প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার নিয়ে, নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিয়েছে আমাদের কাছে। এতটুকু লজ্জা, সংকোচ, কৃপণতা অথবা কোন শর্ত তো সে রাখেনি! আমাদের দু’ হাত ভরে উপছে পড়ছে তার দান। কোন শর্ত সে দেয়নি বলে, কোন কনট্রাক্ট সে করেনি বলে ব্রীচ অফ্ কনট্রাক্টরেও কোন বালাই নেই। নেই চুক্তিভঙ্গের অপরাধে কোন শাস্তি। তাই কত সহজেই আমরা পৃথিবীর সব সম্পদ ভোগ করি, উপভোগ করি। আর সেই পরম বন্ধুকে ইচ্ছেমত নির্বিচারে নির্যাতন করি, কষ্ট দিই।
কথামালার বইতে, প্রবাদ বাক্যে, গল্প-উপন্যাসে বন্ধুত্বের কত অমর উপাখ্যান আমরা পড়ে মুগ্ধ হই, চোখের জল ফেলি আর কামনা করি যেন এমন বন্ধুই জীবনে আসে। কি হাস্যকর ভন্ডামি আমাদের এই মুগ্ধতা, চোখের জল আর প্রাণের চাওয়া। বড়াই করে লিখি- এ ফ্রেন্ড ইন্ নিড, ইজ এ ফ্রেন্ড ইন্ ডীড। কি করে লিখতে পারি আমরা এই কথা! কি করে ভাবতে পারি! যে বন্ধু, এই পৃথিবী- বন্ধু, আমাদের সব প্রয়োজন মেটায়, না চাইতেই সব মেটায়, যাকে মুখ ফুটে বলার কোন প্রয়োজনই পড়েনা, তেমন বন্ধুকে আমাদের কখনো মনেই পড়ে না! আসলে এই পৃথিবী- মায়ের ব্যপ্তি, আর গভীরতা আর আমাদের প্রতি তার অতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করার মত এতোখানি মানসিক গভীরতা বা হয়ত মানসিক উদারতা আজও আমাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। এটাও তো ঠিক অতি বৃহৎ, না, অতি বৃহৎই বা কেন বলবো, সর্ববৃহৎ যে, সর্বোত্তম যে, তাকে ভালোবাসার জন্য নিজেদেরকে তৈরি করতে হয়। উত্তরণ ঘটাতে হয় নিজেদের মননের। এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আচমকা আরো একটা কথা মনে এলো আমার। আচ্ছা, এমন কোন পথ কি বের হতে পারে না, যে পথে চলতে চলতে আমরা, এই পৃথিবীর সমস্ত মানুষ পৌঁছে যাব পৃথিবীর খুব কাছে, একেবারে কাছে। হ্যাঁ, খুব সচেতনভাবেই এই কথাটা আমি বলছি, কারণ আমরা জন্মাই এই পৃথিবীর বুকে, বিচরণ করি এই পৃথিবীতে, যাবতীয় সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ ভোগ করি এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আর পৃথিবীর থেকেই যাবতীয় উপাদান সংগ্রহ করে, আর মারা যাবার পরেও জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে মিশে যাই এই পৃথিবীতেই! অর্থাৎ পুরো জীবন-চক্রটাই সম্পন্ন হয় এই পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়েই, তবু এই পৃথিবী, আমাদের আপন হতে পারেনি।
তাই এই একান্ত ভাবে একাত্ম হওয়ার জন্য এমন একটা সূত্র খুঁজে পেতে হবে, যা মানুষ ও পৃথিবীকে মানসিক বন্ধনে আবদ্ধ করবে। যখন মানুষ মেনে নেবে তার প্রকৃত আত্মীয় এই পৃথিবীই, তখন আসবে শান্তি কারণ মানুষ যখন পৃথিবীর সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে ভোগ, উপভোগ ও যত্নে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বুঝবে, তখন কেউ ইচ্ছে করে পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে না, আর এক দেশের দখলদারি নেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে না, প্রাকৃতিক সম্পদকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রত্যেকেই তার সাধ্যমত চেষ্টা করবে, যখন মানুষ অন্তর থেকে উপলব্ধি করবে সব ধর্মের বড় ধর্ম পৃথিবী-ধর্ম, পৃথিবীকে ভালোবাসার ধর্ম, তখন ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য হানাহানিও বন্ধ হবে। আমরা প্রত্যেকে জানি হাজার হাজার বছর ধরে এই পৃথিবীর নানা প্রান্তে ধর্মের নামে নানা গোষ্ঠী ও ধর্মীয় অনুরাগীদের মধ্যে যত সংঘর্ষ হয়েছে, যত প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হয়েছে এবং যত প্রাণহানি ঘটেছে, তা আর অন্য কোনভাবে ঘটেনি। একমাত্র সেই সুত্রই পারে, সেই অবয়বহীন নিরাকার সূত্রই পারে স্থায়ী বিশ্বশান্তি আনতে। হ্যাঁ, এইতো পেয়েছি, সেই সূত্রের নাম হবে ‘স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র’, আর এই বিশ্বশান্তি সূত্রই অদৃশ্য বিনা সুতার মালায়গাঁথবে এই গোটা বিশ্বকে!
পৃথিবীকে ভালবাসলেই মানুষ নিজের চারপাশকে দূষণমুক্ত, পরিচ্ছন্ন রাখার যেমন চেষ্টা করবে, নিজের দেশকে ভালোবাসবে, নিজের দেশের অন্তর্গত ভূখন্ড ও তার সমস্ত প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদকে ভোগ করার সাথে সাথে উপযুক্তভাবে সংরক্ষণের চেষ্টাও করবে। এই পৃথিবীকে এবং পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য ও সম্পদকে মানুষ যখন ভালবাসবে, তখন মানুষের মন হবে শান্ত, তার ভাবনা হবে গভীর। তার সিদ্ধান্ত হবে স্থির ও সবার পক্ষে কল্যাণকর। আমার সাথে সাথে যখন আমি আমার প্রতিবেশীর ভালোটাও ভাবতে পারবো এবং একইভাবে প্রতিবেশীও আমার ভালো ভাবতে পারবে, তখন সামগ্রিকভাবেই ভালোলাগার, ভালোভাবার ও ভালোবাসার পরিবেশ তৈরি হবে। তখন কেউই জোর করে বা বেআইনি ভাবে অন্যের জমির কিছুটা দখল করে নেওয়া বা সরকারি জমির উপর পাঁচিল তোলা, দোকান তোলা- এই ধরনের কোন কাজই করবে না মানুষ, কারণ তার মনে এই ধারণাটা একটা পরিষ্কার রূপ নেবে যে সরকারি জমি বা সম্পত্তি বলে যা যা আছে, সেগুলো আমাদেরই। বিভিন্ন ট্যাক্সের খাতে দেওয়া আমাদেরই টাকায় সেই জিনিস তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। আমাদের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আমাদের ব্যবহারের জন্যই এই সমস্ত নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করেন প্রশাসনিক সাহায্য নিয়ে। এইভাবে যখন একটি দেশের মানুষ ভাবতে পারবে, তখন সেই দেশের অর্থনৈতিক চেহারাটাই আমূল বদলে যাবে। কারণ কোন একটি বিশাল প্রজেক্ট, সেটা কোন বিশাল ব্রীজ বা ন্যাশনাল হাইওয়ে নির্মাণ বা অন্য কিছু হোক, সেই নির্মাণের কাঁচামাল হবে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট, সেখানে থাকবে না কোনো দুর্নীতির ছোঁয়া। কারণ ঐ যে বললাম, পৃথিবীর সব সম্পদকে যখন নিজের বলে ভাবতে শিখবে, নিজেদের নির্মিত কোন জিনিসকেও একান্তভাবে নিজের বলেই ভাববে।
আমরা নিজের বসবাসের জন্য বাড়ির ভিত তৈরীর চেষ্টা করি, সেরা উপাদান দিয়ে মজবুত, শক্তপোক্ত করে সেই ভিত তৈরি করতে, যাতে বহু বছর সেই বাড়ি অটুট থাকে। এর ফলে যে ব্যপারগুলো ঘটে সেগুলো হলো, অনেক অনেক বছর সেই বাড়ির স্থায়িত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া, আমাদের কষ্টার্জিত অর্থের সঠিক ব্যবহার হওয়া এবং আমাদের পরিবারের মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া। ঠিক তেমনিভাবেই এর আরো একটা দিক আছে। আমরা শক্তপোক্ত ও মজবুত করে ঘরবাড়ি বানালে, বহুদিন আর সেই বাড়ির জন্য বড় অঙ্কের অর্থ খরচ হয় না। কিন্তু বাড়ি তৈরীর উপাদান অর্থাৎ কাঁচামাল যেমন, ইট, বালি, সিমেন্ট, রড- এসব যদি নিম্নমানের হয়, তাহলে কিন্তু কিছুদিন পরেই সেই বাড়ি বা বাড়ির অংশ ভেঙে পড়তে পারে, আহত বা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নিহতও হতে পারি আমি বা আমার বাড়ির লোক, যে ক্ষতি হবে অপূরণীয়! বাড়ির মেরামতের জন্যও নতুন করে টাকা লাগবে। যে অর্থ ক্ষতিটা একজন সাধারণ মানুষের কাছে রীতিমতো কষ্টদায়ক। ঠিক তেমনি ভাবেই জনসাধারণের জন্য বানানো কোন ব্রীজ বা রাস্তা ইত্যাদি যদি বানানোর কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে পড়ে, তাহলে নতুন করে বানানোর জন্য আবার বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। অর্থাৎ প্রথমে সেই প্রোজেক্টের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল সেই বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়ায় দুইগুন, আড়াই গুণ বা তিনগুণ। চাপ পড়ে কোষাগারে। যে বাড়তি অর্থ খরচ হয়, সেই অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অন্য কোন জরুরী বিষয়ে খরচ হতে পারত! এই অর্থও তো আমাদের সবারই অর্থ। এই অর্থের সঠিক ব্যবহারও তো অত্যন্ত প্রয়োজন। এটা একমাত্র হতে পারে স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্রকে মানুষ যদি আপন করে নিতে পারে তার দৈনন্দিন জীবনে ও তার ব্যবহারিক জীবনে।
এই স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র যখন আমার প্রতি মুহূর্তের ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠলো, তখন আমি, যাদের সঙ্গে আমার প্রতিদিনের ওঠাবসা, তাদেরকে আমার এই ভাবনার কথা বলতে শুরু করলাম। বিভিন্ন ঘরোয়া আলাপচারিতায় আমি মেলে ধরতে শুরু করলাম আমার উপলব্ধির কথা। প্রথম প্রথম হয়ত তাদের পক্ষে এই ভাবনাকে আয়ত্ত করা একটু শক্ত ছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে তারা এই ভাবনায় জারিত হতে শুরু করল। আমার এই ভাবনা তাদের আকৃষ্ট করল। ক্রমশঃ আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠান সভায় ডাক পেতে শুরু করলাম। এই স্থায়ী বিশ্বশান্তি সূত্র নিয়ে আমার কথা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকলো অগণিত মানুষ। আমার কাজের ও ভাবনার গতিপ্রকৃতি নিয়ে আমি পরম শ্রদ্ধেয় দলাই লামা কে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম।তাঁর উত্তরে অভিভূত হয়েছিলাম। কারণ তিনি আমাকে আশীর্বাদ করে লিখেছিলেন আমার এই ভাবনাকে একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ যেন আমি নিই। তিনি আরো জানান, এই পৃথিবীর মানুষকে একসূত্রে বাঁধার আপনার যে প্রয়াস, তার জন্য আমার সমস্ত শুভ কামনা রইল আপনার প্রতি। তাঁর এই বার্তায় আমি প্রবল ভাবে উৎসাহিত হলাম।এই ভাবেই আমার ভাবনা ও কাজের অভিমুখ স্থির হয়ে গেল। একদিন, পৃথিবী ও কলাবিপ্লব দিবসে পৃথিবীর জন্মদিন পালনের যে অংকুর মাথা চাড়া দিয়েছিলো ২০১৫ সালে আমার অনুভবে, সেই অংকুরই আজ স্থায়ী বিশ্বশান্তির রূপ ধরে সারা বিশ্বব্যাপী এক মহীরুহে পরিণত হবে, সেই ইঙ্গিত আর সেই সম্ভাবনা যেন সেই ছোট্ট বীজের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল।