সাত

এবার আসব ২০১৭-এর ‘পৃথিবী ও কলা বিপ্লব দিবস’ এর প্রথম বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে৷ আমি আগেই বলেছি, মঞ্চের উপর রোদ পড়ছিল, অনুষ্ঠানের আগে সকালবেলায়৷ আর আমি ভাবছিলাম---এই রোদ পড়েছে মঞ্চের ওপর নয়---যেন ঐ রোদ পড়েছে---আমার স্বপ্নে, পৃথিবীর মানুষের অনুভবে৷ এই জাতীয় আরো কতগুলো কথা৷
হ্যাঁ, দিনটা ১৫ই জানুয়ারি৷ ২০১৭ তে ১৫ই জানুয়ারি ছিল আমার নতুন জন্মের শিহরণ৷ পরপর নানা লোকজন আসছে৷ দেখছে অনুষ্ঠানের বহর৷ গ্রামের সরল মানুষেরা স্বপ্ণ দেখছে---এখানে বিরাট উৎসব হবে৷ অনেক লোকজন আসবে৷ নাচা-গানা হবে৷ আর হবে ১০০ কেজি কেক কাটা৷ কেকটি পৃথিবীর মানাচিত্রের আদলে আঁকা কেক৷
ওদের চোখে এটা বিষ্ময়৷ আমার চোখেও বিষ্ময়৷ কারণ লক্ষাধিক টাকা প্রায় যার মূল্য, সেই কেকটা আয়তনে একটি ছোট মঞ্চের সমান, সেখানে রাখা হবে, কেকটা আসবে৷
সব-ই খরচ আমার৷ কিন্তু মঞ্চে আমার অন্য অনুভূতি৷
লোকে ভাবছে---আমি ভিখারি হচ্ছি, আমি ভাবছি---আমি রাজা হচ্ছি৷ কারণ এত মানুষ আসবে---জনসমুদ্র হবে---এই বিশ্ব শান্তি ভাবনা বা সূত্রের বাস্তবায়ন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে---বিশ্বমাতা খুশি হবে, এই অনুভূতি আমাকে রাজা করে তুলল৷
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার চালচলনে সেই ভাবভঙ্গি৷ না, কোনো ঔদ্ধত্য নয়৷
বরং সত্য ও সুন্দরের চরমতম আরাধনায় যেন আমার মন আত্মা শরীর শুদ্ধ হয়ে উঠেছে৷ মানুষেরা পরপর আসছে, ছাত্র-ছাত্রী, বাবা-মা, দাদু-দিদা, সবাই আসছে---অনুভব করতে পারছি এরা একদিন এই ভাবনা নিয়ে মানসিক বিপ্লব আনবে চারপাশে৷
প্রচণ্ড শীত, দেশটা ভারত, আবার পশ্চিমবঙ্গ৷ শীতকালে খুব শীত হয় না সাধারণত৷ কিন্তু যখন ধরে, কামড়ে ধরে, আসলে নদী তীরবর্তী এলাকা---শীতের তীব্রতা বেশি৷
এইদিন সকালে ছিল প্রায় ২২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, রাত পর্যন্ত অনেক কমে যায়৷ এক এক দিন এত শীত হয় মানুষ থরথর করে কাঁপতে থাকে৷ এটা তো শীত প্রধান রাজ্য নয়, তাই এখানে একেক দিন যখন ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতা নেমে যায়, সেটা আমাদের এই রাজ্যের ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর বলা যায় অনেক সময়৷ এই বিশেষ সময়ে অনেক মানুষ মারাও যায়৷
এবার মঞ্চের কথায় ফিরে আসি৷ তার আগে আমি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে কত বাহারি করেছি আলো দিয়ে, মাইক-বক্স দিয়ে, আর নানাভাবে সাজিয়ে৷
মানুষের মনে একটাই কথা, এটি এমন অনুষ্ঠান পৃথিবীতে আর অশান্তি আনবে না, কেউ কাঁদবে না, এই উপলব্ধিটা ছড়িয়ে যাচ্ছে পরপর কীভাবে যেন৷ আমার কানে আসছে তাদের কথা৷ তাদের চালচলনের মধ্যে এসে গেছে একরকম তৃপ্তির দোলা৷ যেন এই মাত্র এসে গেছে বিশ্ব শান্তি ঘরে ঘরে৷
পরপর এবার অনুষ্ঠান শুরু হবার সময়৷ ফিতে কাটা হল জাপানের নিশিন কর্পোরেশনের কেইতা কাবাইয়ামার হাতে৷ তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী৷ এখানে বিশিষ্টজন প্রতিটি মানুষ, কারণ সকলেই শান্তির জন্য অহিংস বিপ্লবের সহযোগী যোদ্ধা৷ কিন্তু যে কাজগুলি ঘটনাক্রমে উল্লেখ করতে হচ্ছে, অনুষ্ঠান বা প্রাসঙ্গিক বিষয়ের তাগিদে সে কাজগুলির সাথে বা কাজের মুহূর্তগুলির সাথে যাঁরা ছিলেন তাঁদের নাম বলতেই হচ্ছে৷
নাটশাল গ্রাম, নদী তীরবর্তী একটা গ্রাম৷ সেখানে হচ্ছে স্থায়ী বিশ্বশান্তির জন্য বিশ্ব আন্দোলনের প্রথম অনুষ্ঠান৷ আমি ভাবতেও পারছি না৷ অষ্ট্রেলিয়ায় যার বীজ তৈরি, ভারতে সেটা রোপণ করা হল৷
আর কাবাইয়ামা যখন ফিতে কাটলেন, আমার বুকটা কেমন যেন করে উঠল, কারণ এসব আমার ভাবনার বাইরে ছিল৷ তাঁকে সময় মতো আনতে পারবো, তিনি সায় দেবেন কিনা, এসব আমার কাছে জিজ্ঞাসার বিষয় ছিল৷
কিন্তু, কাজ করছি তো বিশ্বমাতার জন্য, তিনি যা করবেন তা হবে---আমি ভাবব, ভাবাব, আর ফল কী হবে সেটা তাঁর ব্যাপার৷ আমি আর কী করতে পারি৷
জন সমাগম হতে থাকলো৷ অনেকেই দেখছে---অনুষ্ঠানে লোক হয়েছে৷ যেন কোনো প্রাচীন মেলার রূপ নিতে শুরু করল৷ গ্রাম্য সরল মানুষেরা এটাকে বলল পৃথিবী ও কলা বিপ্লব দিবসের মেলা৷ কেউ বলল, পৃথিবীর জন্ম দিবসের মেলা৷ এদের এই সরল উচ্চারণ আমার কাছে অন্য আবেদন তৈরি করল৷ ওদের সরল অনুভূত দিয়ে ওরা এটাকে এভাবেই ব্যাখ্যা করে৷ আমার আরও ভালো লাগল, ওরাও এই ব্যাপারটার মধ্যে ঢুকে পড়েছে৷
না, আমি কিন্তু এটাকে মেলা দেখলাম না, এই দিবসটাকে দিবস হিসেবেও দেখলাম না---অনুষ্ঠান হিসেবেও দেখলাম না, আমি দেখলাম এই যে হাজার হাজার মানুষ শিশু থেকে বাবা-মা, দাদু-দিদা এরা যেন সকলেই একত্র হয়ে এখানে বিশ্বশান্তির জন্য সৈনিক হিসেবে জীবন শুরু করল৷
এখান থেকেই যেন আমরা কোনো অজানার দিকে যুদ্ধ করতে করতে চলেছি একত্রে, স্থায়ী বিশ্ব শান্তির পাতাকা ওড়াতে৷
এদিকে কেক কাটা হলো, ৩০টি ভাষায় হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ গাওয়া হল, সবই চলছে, ৫০০০০ মানে অর্ধলাখ লাল গোলাপ পড়েছে বিশ্বমাতার বেদীতে৷ আর কাবাইয়ামা যখন পাঁকাটির মত সুন্দর শরীর নিয়ে প্যান্ট শার্ট পরে বিশ্বমাতার বেদীতে ফুল দিয়ে জাপানি কায়দায় প্রণাম করছিলেন তা ছিল দেখবার মতো৷
হাজার হাজার মানুষ দেখছেন, জাপানের মানুষটাকে৷ কেউ বলছে, মাইকেলটা এতদূর এগিয়েছে, এতদূর যে এগোয়, সে কি পিছতে পারে! নানা মনের নানা কথা ভিড়ের মধ্যে থেকেও আমার কানে আসতে থাকল৷
শুরু হল, তপন কুমার মাইতিকে দিয়ে লেখানো, ‘পৃথিবীর জন্মদিনে’ কবিতাটি৷ উনি শিক্ষক ও কবি৷ না, প্রথাগত নিয়মে কোনও প্রতিষ্ঠিত কবি নন৷ গ্রাম্য অচেনা এক কবি৷
কিন্তু প্রতিষ্ঠিত শব্দটা কোথায় কীভাবে কারা ব্যবহার করেন, জানি না৷ যে-কর্ম সফল হয় যাঁর দ্বারা---তিনি সেই সফলতা থেকে সেই নিয়মেই তো প্রতিষ্ঠিত---কে যেন বলেছিলেন কথাটা, মনে পড়ছে না৷
উনি প্রতিষ্ঠিত হলেন এই কবিতায়, জনারণ্যে৷ এ কী রোমহর্ষক কবিতা৷ গ্রামের একজন গৃহশিক্ষক, ছাগল গোরু নিয়ে ঘরোয়া জীবন যাপন করেন--- নিজের মতো কিছু লিখতেন---তাঁর হাত থেকে এক লেখা৷ মানুষ চমকে গেল৷
কলকাতা থেকে যাঁরা অতিথি এসে ছিলেন, তাঁরাও অবাক৷ অবাক সংবাদ জগৎ৷ গাওয়া হল তপন কুমার মাইতির লেখা গান, ‘পৃথিবী ও পৃথিবী, তুমি নাও গো আমার প্রণাম’৷ সুর দিলেন মাধবী মজুমদার, মঞ্চে গাইলেনও তিনি৷
মঞ্চস্থ হল মাইকেল জ্যাকসন আর্থ সঙ-এর গ্রুপ নাচ৷ এ নাচ যখন হচ্ছিল, ভাবছিলাম, এখানেই একদিন মাইকেল জ্যাকসন নাচবেন৷
না, মাইকেল জ্যাকসন তো আর পৃথিবীতে নেই, অকাল মৃত্যু হয়েছে তাঁর৷ কিন্তু পরক্ষণে মনে হল, আজ এখানেই মাইকেল জ্যাকসনের গানে নাচ হচ্ছে, আগামীতে এখানে আসবে পৃথিবীর সেরা শিল্পীগণ---মাইকেল জ্যাকসনের মতো৷
পৃথিবী আমার জন্ম স্থান, কিন্তু এটা আমার ভাবনার ক্ষুদ্রতা নয়, বরং বলব, কেন জানিনা, এই মাটির সাথে, ওই পরিবেশের সাথে আমার যেন আলাদা জানা, ভালবাসা৷ মানে এখানে আমি নাটশাল গ্রামের কথা বলছি৷
ওই নাচের কোরিওগ্রাফার ছিলেন সুপর্ণা চক্রবর্তী৷ ওঁদের নৃত্য আপনারা অনেকেই হয়তো ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখেছেন৷
বলতে বলতে রাত এল, প্রখর শীত, কেউ বাড়ি যাচ্ছে না, কারণ স্থায়ী বিশ্ব শান্তির স্বপ্ন তাঁদের শরীর ও মনকে গরম করে রেখেছে৷ কেউ কেউ, যারা খুব দূর থেকে এসেছিল, তারা এসে অনেকক্ষণ থেকে চলে যাচ্ছে৷ আসলে সকলের পরিস্থিতি এক নয়৷ কিন্তু হাজার হাজার লোক আসছে, কেউ চলে যাচ্ছে৷ এটাতেও একটা গতিময়তা উপলব্ধি করলাম৷
বুঝলাম এইভাবেই পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ লোকালয়ে এই ভাবনা চলে গেল, মানুষ শীতকালেও গরম অনুভব করবে এই দিবসে, এই উপলব্ধিতে, এই ভাবনার প্রতি ভালোবাসায়৷
মনে মনে হঠাৎ হঠাৎ হকচকিয়ে যাচ্ছি, আমার পকেট শূন্য হতে চলেছে পরপর৷ বাইরে কোর্ট-প্যান্ট পরে, মেজাজ দেখিয়ে হেঁটে চলেছি---যেন ধনী রাজপুত্তুর৷
না, আমি নিশ্চিত জানি, এত কিছু, সব তো বিশ্বমাতার জন্য, যিনি নিজে গোপনে কেঁদে কেঁদে আমাদের সব দিয়ে চলেছেন, তার চেয়ে নিঃস্বতা কি আমার বেশি!