একটা খুব জনপ্রিয় বাংলা গান এই মুহূর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে জানেন- পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা! সত্যিই খুব মন ছুঁয়ে যাওয়া একটা বাংলা গান, যা বাংলা গানের জগতে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে বিরাজ করবে! আর এই গানটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার এটাও মনে পড়ে যাচ্ছে, একটুও না হেঁটেও কিন্তু আমরা, মানে আপনারা আর আমরা কতটা পথ হেঁটে এলাম বলুনতো! সেই শুরু করেছিলাম আমাদের বাগানে বসে আমার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে! আর আমার বন্ধুরাও যে প্রথম থেকেই আপনাদের ভীষণ আপন করে নিয়েছে, তা তাদের হাসি মুখ আর আনন্দে মাথা নাড়া দেখেই আমি বুঝেছিলাম। আসলে কি জানেন, আমার এই বন্ধুরা বড় সরল আর বন্ধুবৎসল! যে তাদের কাছে আসে তাকেই তারা দু’হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানায়! এতই নিষ্পাপ তারা যে ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারে না, যে লোকটাকে তারা স্বাগত জানালো, হয়তো সেই লোকটাই একটু পরেই তাদের খুন করবে! আর এমনই বোকা তারা, এতই ভালো যে খুন হতে হতেও এতটুকু আর্তনাদ বা প্রতিরোধ গড়ারও চেষ্টা করে না! ওহো, আবেগতাড়িত হয়ে ভুলেই যাচ্ছিলাম যে আমাদের ভাষায় তো আমার বন্ধুরা কথাই বলতে পারে না! যদিও আমি তাদের সব কথাই বুঝতে পারি। যে ভাষায় আমাদের আলাপচারিতা চলে তার মাধ্যম হলো ভালোবাসা আর বিশ্বাস। দামী একটা কাঠের পালঙ্কে শুয়ে যখন আমাদেরই শিশুসন্তান হাসে, খেলা করে, তখন কি একবারও আমাদের মনে পড়ে যে ঐ পালঙ্কের পাঁজরে আটকে আছে অনেক দীর্ঘশ্বাস, পালঙ্কের ঝক্ঝকে বালিশের তলায় চাপা পড়ে আছে চাপচাপ রক্তের দাগ। আমাদের প্রিয়জন যখন মারা যায়, কতক্ষণে তার শবদেহ দাহ করার জন্য অথবা কবরস্থ করার জন্যে বাড়ি থেকে বের করা হবে সেই চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে, কারণ ধর্মের দিক দিয়েই হোক, আচার-রীতিনীতির দিক দিয়েই হোক, আর বিজ্ঞানের দিক দিয়েই হোক শবদেহ কোন মতেই বেশিক্ষণ রেখে দেওয়া হয় না! অথচ হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ টাকা দামের পালঙ্কও তো শবদেহই! আর সেই শবদেহের উপরেই জন্ম নেয় আমাদের সন্তানরা, বেড়ে ওঠে ওই শবদেহের উপরেই, আবার জীবনের অন্তিম মুহূর্তে আশ্রয় করে সেই শবদেহকেই! শুধু তাই নয় শেষ যাত্রাতেও মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যায় সেই শবদেহই অর্থাৎ এক মৃতদেহ বহন করে আর এক মৃতদেহকে। এর থেকে আশ্চর্যের আর বন্ধুত্বের পরম নিদর্শনের উদাহরণ এই পৃথিবীর বুকে আর একটিও আমরা পাবোনা এই বিষয়ে আমি ততটাই নিশ্চিত, যতটা নিশ্চিত যে, কোনো জীবনের একমাত্র পরিণতি মৃত্যু! একটি গাছ যতদিন জীবিত থাকে ততদিন সেবা করে যায় মানুষের আর যখন জীবন হারিয়ে এক জড় পদার্থে পরিণত হয়েছে, তখনও একই ভাবে সেবা আর সঙ্গ দেয় মানুষকে!
আমার বন্ধুদের কথা উঠলে আমি একটু বেশিই আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। যাক, যা বলছিলাম অধ্যায়ের পর অধ্যায় পেরিয়ে এলাম একসাথে। ভ্রমণ করলাম সারা বিশ্ব! কখনো মরুভূমির বুকে গিয়ে দেখলাম পিরামিড। অবাক হয়ে ভাবতে থাকলাম কোন মন্ত্রবলে এত ভারী ভারী পাথর তারা বহন করে এনেছিলো দূর দূরান্ত থেকে, কি আশ্চর্য নিপুণতায় ঐ সুউচ্চে তুলে পিরামিডের দেহ নির্মাণ করেছিল।
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান দেখে অনুভব করেছি এক সম্রাটের কঠিন-কঠোর রাজধর্ম পালনকারী সত্ত্বার ভেতরের এক প্রেমময় পুরুষের অস্তিত্ব। একটু সবুজ দেখার জন্যে আকুল হয়ে ওঠা স্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন ওই ঝুলন্ত বাগান।
আমরা একসাথে হাত ধরাধরি করে গিয়েছি মাচ্চু পিচ্চুর ঘুমন্ত শহরে। যেন সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিতে পারলেই মুহূর্তে ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে অতি প্রাচীন এক শহর তার ভীষণ ব্যস্ততা নিয়ে আর আমাদের উষ্ণ আমন্ত্রণ জানাবে ইতিহাসের এক থেমে যাওয়া অধ্যায়কে খুব কাছ থেকে দেখার জন্য, আরো অজানা কিছু জানার জন্য যা হয়তো আজও অপেক্ষায় আছে প্রাণের সাড়া পাওয়ার জন্য।
দি গ্রেট ওয়াল অফ্ চায়না বা চীনের মহাপ্রাচীরের গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে আমরা অবাক হয়ে ভেবেছি মানুষের নিষ্ঠা, পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার ঐকান্তিক চেষ্টা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে তবে মানুষ গড়ে তুলতে পারে এমন এক মহাশ্চর্য সৃষ্টি! আবার ওই মহাপ্রাচীরের গায়ে হাত রেখে অথবা কান পেতে কি আমাদের সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় নি! আপনারা প্রত্যেকে বুকে হাত দিয়ে বলুন তো! যেদিন আমরা ঐ চীনের মহাপ্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে পারলাম ঐ মহাপ্রাচীর তৈরীর সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলেন আর তাদের বেশির ভাগকেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল এই প্রাচীরের মধ্যেই! এটা শোনার পর আমার মত আপনাদেরও কি এক মুহূর্তের জন্য অজানা একটা ভয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠেনি! তারপর আবার যখন সেই পাঁচিলের গায়ে হাত রেখেছি বা কান পেতেছি, আমি, আপনি বা আপনারা এবং আমরা সবাই সেই মুহূর্তে আমি নিশ্চিত, আমার মত আপনাদেরও চোখ দুটো এক মুহূর্তের জন্য ভিজে উঠেছিল। আর মনে মনে ঐ মৃত মানুষগুলোর প্রতি ‘আহা’ শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন! কাঠ, পাথর বা অন্যান্য যে উপাদানে এই মহাপ্রাচীর তৈরি, ঐ শরীরগুলোও তো এর সাথে মিশে গিয়ে উপাদানে পরিণত হয়েছিল ; বড় বেদনার এই ইতিহাস। তাই আমরা সবাই কষ্ট পেয়েছি।
এখান থেকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমরা গেছি প্রাচীন রোমে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, শৌর্য, বীর্যে প্রকৃত অর্থেই সেই রোম তখন সমস্ত পৃথিবীর কেন্দ্র হয়ে উঠেছে! রোমকে কেন্দ্র করেই জন্ম নিয়েছে সেই বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য ‘অল্ রোডস লীড টু রোম’ (All roads lead to Rome)। রোমের সেই বিখ্যাত কলোসিয়াম বা অ্যাম্পিথিয়েটার, সেই অ্যাম্পিথিয়েটার যা ছিল তৎকালীন সমাজের ক্রীড়া ও আমোদপ্রমোদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এখানেই কোন উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে জমা হতো সাধারণ মানুষ ও সম্রাটরা। কেউ অপরাধ করলে হাতির পায়ের তলায় পিষে দিয়ে শাস্তিও দেওয়া হতো এখানেই প্রকাশ্যে। কলোসিয়ামের সেই কঠিন পাথরের গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে আপনাদের মত আমিও যেন দেখতে পাচ্ছিলাম রোমান সম্রাটদের অতি প্রিয় খেলা- সিংহের সঙ্গে এক মানুষের লড়াই! বলা ভালো, অসম লড়াই। যে লড়াই শেষ হতো রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত মানুষটির মৃত্যুতে। ঐ অ্যাম্পিথিয়েটরে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার বছরের কালো পর্দা সরে গেল আমাদের চোখ থেকে। আপনাদের মত আমিও দেখছি - অ্যাম্পিথিয়েটরে উপস্থিত হাজার হাজার লোক উল্লাসে চিৎকার করছে আর কলোসিয়ামের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিশাল আকৃতির এক সিংহ ভয়ঙ্কর রাগে গর্জন করছে আর পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটি মানুষের শরীরকে প্রবল আক্রোশে ক্ষতবিক্ষত করছে! মৃত্যুপথযাত্রীর করুণ আর্তনাদ, সিংহের গর্জন আর হাজার হাজার মানুষের আনন্দের উল্লাস ঐ মহাশূন্য অতিক্রম করে আল্লা, ভগবান বা গডের কাছেও পৌঁছে গেল বোধহয়! তিনি কি একটু কেঁপে উঠলেন! তাঁর চোখের কোনায় কি এক বিন্দু জল এসে গেছিল সেই মুহূর্তে? বিশ্বাস করুন, আমি দেখতে পাইনি কিচ্ছু। আপনাদের মত আমিও দু’হাত দিয়ে চোখ বুজে ফেলেছিলাম সেই মুহূর্তে! কিছুক্ষণের জন্য চেতনা কেমন এক অসাড় হয়ে গেছিল। একদিকে এক প্রবল শক্তিশালী হিংস্র বন্য পশু আর একদিকে একজন মানুষ, তা সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন- এ এক অতি অসম লড়াই আর সেই লড়াইয়ের মর্মান্তিক পরিণতিতে এত আনন্দ। যে পৃথিবীর এতো দয়া এতো ভালোবাসা, এতো করুণা আমাদের প্রতি, সেই পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে এতো হিংস্রতা, এতো রক্তপাত।
নাঃ বড় ভারাক্রান্ত লাগছে মনটা। জানি, আমার মত একই মানসিক অবস্থা আপনাদেরও। তাহলে চলুন, একটু অন্য জায়গায় যাই। এবারে আমরা যেখানে যাব সেটা হল ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও ।
আমি এখন আপনাদের সাথেই দাঁড়িয়ে আছি ক্রাইস্ট দি রেডিমিরের সামনে। আর বড় শান্তি লাগছে! এতক্ষণ ধরে ঐ নিষ্ঠুরতা, রক্তপাত দেখার পরে এখানে এই বিশাল মূর্তির পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বড় আনন্দ লাগছে। এক জায়গায় দেখলাম, মানুষ বিকৃত আনন্দের বশবর্তী হয়ে খেলার ছলে মানুষকে হত্যা করছে আর এই স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে সুদূর অতীতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি একটা মানুষ হিংসা, হানাহানি আর মানুষে মানুষে অবিশ্বাস কে বন্ধ করার জন্যে হাসিমুখে নিজের প্রাণ দিচ্ছে! ক্রুশবিদ্ধ হয়েও সেই মানুষটার মুখে অমলিন এক স্বর্গীয় হাসি আর সেই মানুষটি, ঈশ্বরের পুত্র (সন্ অফ গড) ঈশ্বরকে বলছেন- হে ঈশ্বর, এরা জানে না এরা কি করছে! এদের তুমি ক্ষমা ক’রো!
এমন কথা কে বলতে পারে বলুন তো! পারে একমাত্র সেই মানুষই যার জীবনটাই মানুষের ভালোর জন্য উৎসর্গীকৃত! তাই দেখুন, আমার সাথে সাথে আপনাদের চোখেও কেমন জল এসে গেছে! মায়ের কাছে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, আনন্দেও চোখে জল এসে যায়; কিন্তু আজকে এই মুহূর্তের আগে পর্যন্ত সেরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়নি! কিন্তু এই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারছি, মায়ের কথাটা কত সত্যি! থ্যাঙ্ক ইউ মা! সমস্ত ভালো অনুভূতিগুলো চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে! ভালো লাগছে, খুব ভালো লাগছে; আমার মত আপনাদেরও, আমি জানি। একজন মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিলেন অজ্ঞতা, হিংসা আর ঈর্ষার বলি হয়ে অথচ কী অপরিসীম নিরাসক্তিকে তিনি গ্রহণ করলেন সেই মৃত্যুকে। আর এক অমৃত পথের সন্ধান দিয়ে গেলেন এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে, যে পথে হেটে চলেছি আমি ও অসংখ্য মানুষ।
এতক্ষণ বিদেশের নানা জায়গা ঘুরলাম। দেখলাম বিশ্বের প্রাচীন ও নতুন কিছু দ্রষ্টব্য যা মানুষেরই সৃষ্টি। এবারে ভারতবর্ষের একটা দ্রষ্টব্য স্থান দেখতে যাব, যেটা সারা বিশ্বেও খুব সমাদৃত। আমি বলছি তাজমহলের কথা। শ্বেতশুভ্র মায়াবী পরীর মত যা অজস্র মানুষের স্বপ্নে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। প্যারাগন অফ রোম্যানটিসিস্ম বা রোমান্টিকতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে এই তাজমহল। যুগে যুগে কবি, গায়করা এই তাজমহলকে ঘিরে অজস্র গান, কবিতা, গল্পের মাধ্যমে তাঁদের সৃষ্টিকে জনপ্রিয় ও কালজয়ী করে দিয়েছেন।
আপনাদের মত আমিও তাজমহলকে দিনের নানা সময়ে দেখেছি। আপনার মতোই মুগ্ধ হয়েছি ! আসলে আপনাদের সাথে এতদিন একসাথে চলতে চলতে এমনই একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে যে আমাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগাগুলোও কেমন এক হয়ে গেছে। পূর্ণিমার রাতে তাজমহলকে দেখে মনে হয়েছে, এ শুধু একটা রাতের স্বপ্ন; রূপকথার পরীরা যেমন সারারাত তাদের নাচ গানের শেষে ভোর হতে না হতেই আকাশে মিলিয়ে যায়, এই তাজমহলও মিলিয়ে যাবে তেমনি করেই ঐ মহাশূন্যে! কিন্তু এ বড় বাস্তব! বড় নির্মম বাস্তব। একদিকে সম্রাট স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন একটা কিছু সৃষ্টির, যা হবে স্ত্রীর প্রতি সম্রাটের প্রেম ও শোকপ্রকাশের পরম উদাহরণ। স্থাপত্যবিদ্যায় পারদর্শী ও শিল্পী তাঁর বিমুর্ত এই ভাবনাকে রূপ দেওয়ার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করলেন। গড়ে উঠল পৃথিবীর বুকে এমন এক প্রেম সৌধ যা কোটি কোটি মানুষকে হাসালো, কাঁদালো, প্রেমে উদ্দীপ্ত করলো, আবেগে মথিত করলো যুগ যুগ ধরে। সঙ্গীতে, কবিতায়, চিত্রে, চলচ্চিত্রে- এককথায় স্থায়ী রেখাপাত করেছে মানুষের মনে। যুগে যুগে অসংখ্য মানুষ অন্ততঃ একবার ছুটে যেতে চেয়েছে তাজমহলের কাছে। নিজেদের প্রেম, প্রেমহীনতা, বিরহ অথবা মিলন সবকিছুর সাথেই একান্ত অাপন করে নিতে চেয়েছে তাজমহলকে। জারিয়ে নিতে দিয়েছে নিজেদের উষ্ণতা ও আবেগের সাথে। যেমনটা আমরা করেছিলাম। আপনাদের সাথে প্রথমটা তাজমহল দেখে আমারও যেমন অনুভূতি হয়েছিল! কিন্তু ঐ যে একটা বাংলা প্রবাদ আছে না, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে; সেই প্রবাদবাক্যটা আমার মনে পড়ে গেল তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে! যদিও ঢেঁকিরা স্বর্গে কিভাবে আর কোন রুটে গেল আর স্বর্গে ধান উৎপন্ন হয় কিনা আর সেই স্বর্গীয় ধান কোটার জন্য ঢেঁকির প্রয়োজন হয় কিনা, সেসবের কিছুই আমি জানিনা। তবু ঐ কথাটাই মনে এলো! সেই সঙ্গে একটা শায়েরিও মনে পড়ে গেল! আমার কাছে এটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ শায়েরি-
এক্ শাহেনশা নে বানায়ে ইয়ে
হাসিন তাজমহল, হাম
গারিবো কি মোহাব্বত কি উড়ায়া
হ্যায় মজাক্।
একজন সম্রাটের পত্নীপ্রেম বা একজন সম্রাজ্ঞীর পতিপ্রেমের সাথে একজন অতি সাধারণ প্রেমিক-প্রেমিকা বা পতি-পত্নীর প্রেমের কি কোন তফাৎ আছে? উত্তরটা আমার কাছে একই সাথে হ্যাঁ কিংবা না! আপনি জানি প্রিয় পাঠকেরা যারা একসাথে হেঁটে চলেছেন আমার সঙ্গে, আমরা বেরিয়েছি বিশ্বভ্রমণে, তারা যেহেতু এতদিনে খুব কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছেন, তারা আমাকে এবারে একসাথে চেপে ধরবেন, বলবেন ব্যাপারটা কি হলো? এরকম হেঁয়ালির মানেটা কি? কথায় আছে, একসঙ্গে সাত পা হাঁটলেই মানুষ পরস্পরের বন্ধু হয়ে যায়। আর আমরা তো হাজার হাজার কিলোমিটার একসঙ্গে ভ্রমণ করেছি! তাই আমাদের মধ্যে যে নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই বন্ধুত্বের দাবিতে এই প্রশ্ন আপনারা রাখতেই পারেন যে, কোনো প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে হ্যাঁ এবং না কিভাবে হয়? আমার প্রিয় পাঠকেরা, যারা আমার সঙ্গেই আছেন, তারা মন দিয়ে শুনুন। আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিচ্ছি।
প্রেম একটা গভীর মানসিক অনুভূতি। এই অনুভূতি সম্রাটের বা একজন সাধারণ মানুষের একই রকম। এখানে সম্রাট বা সাধারণ মানুষের মধ্যে তফাৎ নেই। প্রেমের অনুভূতি কোন সম্রাট বা সম্রাজ্ঞীর ঠিক যতখানি গাঢ়, একজন অতি সাধারণ নর-নারীরও ঠিক ততটাই। তফাৎ শুধু বাহ্যিক প্রকাশভঙ্গিতেই। অর্থাৎ একজন বিপুল আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন ব্যক্তি শুধু ভাবে ভঙ্গিতে-চোখের ভাষায়- শারীরিক অভিব্যক্তিতেই নয়, কয়েন্স আর কাইন্ডসের মোড়কেও তাঁর বিলাসময় প্রেমকে প্রকাশ করতে পারেন। খুব বেশি ভাবেই পারেন! কিন্তু একজন অতি সাধারণ মানুষের পক্ষে তো তা সম্ভব নয়! একমাত্র কল্পনাতেই সেই চাওয়া তার পূরণ হতে পারে যে সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে অতি মূল্যবান কিছু উপহার দিচ্ছে! সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের তফাৎ ঠিক এইখানেই! অপূর্ব সৌন্দর্যের সাথে সম্রাটের বিপুল বৈভবের কথাও সদর্পে ঘোষণা করে তাজমহল। কোন এক মুহূর্তে তাজমহল দর্শন করে কোন সাধারণ শায়েরের মনে হয়তো গভীর কষ্ট জন্ম নিয়েছিল আর তাই সখেদে সে বলেছিল-
এক্ শাহেনশা নে বানায়ে ইয়ে
হাসিন তাজমহল, হাম
গারিবো কি মোহাব্বত কি উড়ায়া
হ্যায় মজাক্।
এই শায়েরিটা মনে পড়তেই বুকটা কেমন ভারী হয়ে উঠল। চোখের সামনে তাজমহল কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছে ! কুয়াশায় ছেয়ে যাচ্ছে নাকি! না চারপাশে তাকিয়ে দেখছি, সবই তো দেখছি রোদের আলোয় ঝক্মক করছে! তাহলে কি… তাহলে কি আমার চোখেই কুয়াশা! তাড়াতাড়ি চোখে হাত দিলাম! সত্যিই তাই; কুয়াশাই আমার দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, দু’চোখ তাই ঝাপসা হয়ে গেছে! আমার প্রিয় পাঠকরা, আপনারা প্লিজ ওরকমভাবে আমার দিকে তাকাবেন না! আমার খুব লজ্জা লাগবে তাহলে! না বোধহয় ভুল বলেছি, আপনারা তো আমার পরম আত্মীয়-আপনাদের কাছে তো আমার কোন লজ্জা থাকতেই পারে না! আসলে, আচমকা তো তাই আর কি! এক বাগানভর্তি গোলাপ আর একটা মাত্র গোলাপের সৌন্দর্য আর সৌরভে কি কোন তফাৎ আছে! আমার মনে এই মুহূর্তে এই ঝল্মলে তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সামনে একটা ছবি ভেসে উঠল; এই কথাটা কেন মনে হল, আপনাদের সেটা বলি প্রিয় পাঠক। কাল রাতে আমরা সবাই যখন পূর্ণিমার আলোয় তাজমহল দেখে আপ্লুত, সেই আলোচনার রেশ নিয়েই যখন শুতে গেলাম, একটু পরেই একটা স্বপ্ন দেখলাম; দেখলাম যে আমি একটা গোলাপ বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আর একজন মধ্যবয়সী লোক বাগানের ভেতরে একটা একটা করে গাছ থেকে খসে পড়া গোলাপ কুড়োচ্ছে! অথচ বাগানে গাছ ভর্তি গোলাপ ফুটে আছে! আমি অবাক হয়ে দেখছি লোকটার কান্ড, এমন সময় লোকটা দু’হাতে অনেকগুলো ঝরে পড়া গোলাপ হাতে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমাকে ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বললো- কি, আপনি খুব অবাক হয়ে গেছেন দেখছি! আমি থত্মত খেয়ে বললাম, না, আসলে গাছে এতো গোলাপ ফুটে আছে, অথচ.... লোকটা আমাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে বললো- অথচ এত ফুল কুড়োলাম কেন; তাইতো! আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম- না- না। আমি- লোকটা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো - না- না আপনি লজ্জা পাবেন না। এই ফুলগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি আমার বেগমের জন্য! ও সব সময় বলতো- যে ফুলগুলো মাটিতে ঝরে পড়ে যায়, তাদের যদি কেউ মাড়িয়ে দেয় তাহলে পৃথিবী- মা কষ্ট পায়, খুব কষ্ট পায়! তুমি রোজ ঝরা ফুলগুলো তুলে এনে সাজিয়ে দিও। তাহলে ওরাও খুব আনন্দে থাকবে আর পৃথিবী- মাও খুব নিশ্চিন্ত হবেন! আর যেদিন ওরা একদম শুকিয়ে যাবে, সেই দিন ওরা এই পৃথিবীর বুকেই মিশে যাবে! চলি-
লোকটা একটু একটু করে হেঁটে হেঁটে দূরে চলে যাচ্ছে ! হঠাৎ আমার সাড় ভাঙলো- দুর থেকে চেঁচিয়ে বললাম- শোনো, শোনো- লোকটা দাঁড়িয়ে পড়লো, কিন্তু আমার দিকে ফিরল না। আমি বললাম- তুমি বললে তোমার বেগম তোমাকে বলতো; এখন বলেনা! এখন সে কোথায় থাকে আর কোথায়ই বা ফুলগুলো সাজিয়ে দিতে বলল? লোকটা এবার আমার দিকে ফিরল আর দূরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল- আমার মমতা বেগম ওইখানে শুয়ে আছে আর ওঁর কবরে ফুল গুলো সাজিয়ে দিতে বলেছে! আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে; আমি প্রাণপণে শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে তবু চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম- আপনার নাম কি? লোকটা হেসে বলল - শাহজাহান! তারপর চেঁচিয়ে বলল-
এক্ শাহেনশা নে বানায়ে ইয়ে
হাসিন তাজমহল, হাম
গারিবো কি মোহাব্বত কি উড়ায়া
হ্যায় মজাক্।
এই কথা বলতে বলতে লোকটা হাঁটা দিল আর ধড়মড় করে আমি বিছানায় উঠে বসলাম! সেই থেকেই কানে বাজছে লোকটার শেষ কথাগুলো আর ভাবছি কার সৌন্দর্য বেশি! এই তাজমহলের নাকি ওই ঝরে পড়া গোলাপ গুলোর! সূর্যস্নাত এই তাজমহল কি তার সৌন্দর্যে ঢেকে দিতে পারবে মাটিতে পড়ে থাকা গোলাপগুলোর রূপ আর সুগন্ধ! আমি একেবারে একশো ভাগ নিশ্চিত কখনোই তা পারবে না কারণ মানুষ যা সৃষ্টি করেছে তার উপাদান সে সংগ্রহ করেছে এই পৃথিবী থেকেই, আর মানুষের সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে কখনো তার অহং চরিতার্থ করার জন্য, কখনো যুগ যুগ ধরে নিজের নামকে এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আবার কখনো বা শৌর্য বীর্য বা প্রেমকে বিজ্ঞাপিত করার জন্য!
কিন্তু এই পৃথিবীর তো তা নয়! পৃথিবী কখনোই নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে চায়না! তার সৃষ্টির জন্য না লাগে কোন অর্থ, না লাগে কোন লোকবল, না লাগে কোন স্থপতি আর না লাগে স্থাপত্যবিদ! সৃষ্টির আনন্দে বিভোর পৃথিবী আপন খেয়ালে, আপন ছন্দে তার অনন্য সৃষ্টির সম্ভার তুলে দেয় আমাদের হাতে ভোগ আর উপভোগ করার জন্য! নিঃস্বার্থ সেবা, অপরিসীম আত্মত্যাগ আর পরম ভালোবাসার একমাত্র ও চূড়ান্ত উদাহরণ এই পৃথিবী ব্যতীত আর কেউ বা আর কিছু হতে পারে কি! প্রিয় পাঠক, আমরা যে এত এত জায়গা ঘুরলাম একসাথে, তারপরে কি আমার মত আপনাদেরও একথা মনে হচ্ছে তো! আমি জানি হচ্ছে আর এটাই পৃথিবী মায়ের সর্বোত্তম আশীর্বাদ আমাদের প্রতি।
মানুষের তৈরি বেশ কিছু দ্রষ্টব্য স্থান ঘুরে, আমরা সেইসব স্থানের কথা নিয়ে কিছু আলোচনা করলাম! আসলে এই আলোচনা আমার কাছে সেই স্বচ্ছ আয়না, যে আয়নায় অন্তরের সত্য প্রতিফলিত হয়। এই আলোচনার সময় আপনাদের উৎসুক, উদ্দীপ্ত মুখগুলো আমাকে উৎসাহিত করে, অনুপ্রাণিত করে। আমার সব সময় মনে হয় এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে আমি প্রতিমুহূর্তে সমৃদ্ধ হই। তাই এখন আমরা, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অজস্র পবিত্র ধর্মীয় স্থানের কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করবো যেগুলো আমরা একসঙ্গে ঘুরে এলাম এই কয়েকদিন আগে। প্রথমেই অত্যন্ত বিখ্যাত ও আলোচিত পবিত্র ধর্মীয় স্থানের কথা নিয়ে কিছু বলবো, আমরা সর্বপ্রথমে সেই স্থানটিতেই গেছিলাম, সেটি হল জেরুজালেম শহর। এই জেরুজালেম শহর ও অন্যান্য যে পবিত্র স্থানগুলোতে আমরা ভ্রমণ করে এসেছি, সেগুলি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা আমার পঞ্চম অধ্যায়ে করেছি। তার পুনরাবৃত্তি এই অধ্যায়ে করবো না; এই প্রসঙ্গে আমাদের কিছু কথা বলবো। পৃথিবীর সর্বত্র নানা ধর্মীয় গোষ্ঠী, নানা ধর্মের মানু্ষ, তাদের আচার, অনুষ্ঠান, সংস্কার, নানা রকম ধর্মীয় অনুশাসন ও বিশ্বাস অনুযায়ী অজস্র মঠ, মন্দির, গীর্জা, মসজিদ গড়ে তুলেছে! সেইসব ধর্মীয় স্থানগুলি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সেই ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এবং সেই ধর্মস্থানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে প্রবল ভাবাবেগ এবং সংস্কার। জেরুজালেম শহর নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছি। পৃথিবীর অত্যন্ত প্রাচীন এই শহর, তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম বৃহৎ ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
ধর্মগুলি হল জুডাইসম, খ্রীস্টান ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম। তেমন ভাবেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে হিন্দু ধর্মের কোটি কোটি মানুষের কাছে এই ভারতবর্ষেরই উড়িষ্যার পুরীর জগন্নাথ মন্দির এবং উত্তরপ্রদেশে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় স্থান। আবার বৌদ্ধদের কাছে অতি পবিত্র স্থান বুদ্ধগয়া। সেখানে বুদ্ধদেব মহাজ্ঞান লাভ করেছিলেন, সেই জায়গাটা। আবার সৌদি আরবের মক্কা-মদিনা! এটিও ইসলাম ধর্মের মানুষের কাছে মহা পবিত্র স্থান। এই ভাবেই যুগে যুগে পৃথিবীর নানা স্থানে পবিত্র ধর্মীয় স্থান গড়ে উঠেছে। চারপাশে এত এত ধর্মীয় স্থান, পবিত্র স্থান, অথচ সারা পৃথিবী জুড়ে সেই শান্তির বাতাবরণ কোথায়! প্রত্যেকটি ধর্মের একেবারে গোড়ার কথা হলো পরধর্মের প্রতি সম্মান ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন। অথচ তা কি সত্যিই পালিত হয়েছে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে! তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে তার অধিকাংশই হয়েছে ধর্মের নামে, ধর্মের উন্মাদনায়! ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লড়াইতে যত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, যত প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট হয়েছে আর যত দেশ ধ্বংস হয়েছে তার হিসেব রাখতে গেলে একটা মানুষকে শুধু সেই কাজেই সারা জীবন ব্যস্ত থাকতে হবে! অথচ এমনটা তো হবার কথা নয়! এই পৃথিবী তার নিজ গুণেই সর্বত্র অদ্ভুত এক শান্তি আর পবিত্রতার বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছে। প্রকৃতিতে রয়েছে সুবিশাল পর্বত, গভীর সমুদ্র, গহন অরণ্য, উচ্ছল ঝরনা আর প্রাকৃতিক ভাবে নির্মিত হ্রদ! তাদের এক এক রকম সৌন্দর্য রয়েছে, বৈশিষ্ট্য রয়েছে, কিন্তু এদের মধ্যে একটা মূল সুর রয়েছে, যে সুর বলে উপকার করো, অপকার নয়; সৃষ্টি করো, ধ্বংস নয় ; ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধো, অনুশাসনের কড়া শৃঙ্খলে নয়। যে সুর ঐকতানের সৃষ্টি করে, ছলে, বলে, কৌশলে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের খেলায় মাতে না। পাহাড়ের বুক থেকে, সমুদ্র থেকে, মাটির গভীরতম প্রদেশ থেকে আর অরণ্য তার নাড়ি ছেঁড়া সম্পদ যখন আমাদের তুলে দেয় তখন কিন্তু প্রকৃতি কোন ব্যবসায়িক চুক্তি করে না আমাদের সাথে! শুধু অনুচ্চারিত আবেদন থাকে তাতে- ভোগ করো, উপভোগ করো, কিন্তু ধ্বংস করোনা; এমন পথ খোলা রাখো যাতে আবার আমরা তোমাদের চাহিদা পূরণ করতে পারি! তখন তো কোনো ধর্ম বা কোন ধর্মীয় অনুশাসন এই বিষয়ে কোন নিয়ম নীতি জারি করে না! এই পৃথিবীর কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ড বা শহর অথবা কোন অঞ্চল কেন কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র হবে? কেন সমগ্র পৃথিবী নয়? একমাত্র এই পৃথিবীই পবিত্রতার প্রতিমূর্তি তার কারণ তার কোনো চাহিদা নেই, কারোর কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই। তার কাছে কোন কিচ্ছু না চাইতেই তার সমস্ত সম্পদ সে তুলে দেয় মানুষের হাতে, আমাদের হাতে। আর যা সে বিনিময়ে পায় তা হল তাকে প্রতিমুহূর্তে ধ্বংস করার আপ্রাণ চেষ্টা! আর সারা পৃথিবী জুড়েই প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তেই চলছে এই কাজ! না কাজ নয়, ভয়ঙ্কর অন্যায় কাজ। যীশুখ্রীস্টের সম্পর্কে একটা গল্প এই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল। একবার যীশুখ্রীষ্ট দেখলেন কয়েকজন লোক মিলে একটা মেয়েকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে আর মেয়েটি প্রাণভয়ে আর্তনাদ করছে। যীশুখ্রীষ্ট তখন সেই লোকগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং জানতে চাইলেন কি হয়েছে! লোকগুলো জানালো ওই মেয়েটি পাপিষ্ঠা, তাই তাকে পাপের শাস্তি হিসেবে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা হবে! ‘ঈশ্বরের পুত্র’ এই কথা শুনে স্মিতমুখে বললেন, এই যদি বিধান হয়, তাহলে তা অবশ্যই পালন করা উচিত তবে এখানে একটা কথা আছে! একমাত্র সেই লোকটিই মেয়েটিকে প্রথম পাথর ছুঁড়ে মারবে, যে জীবনে কখনো কোনো পাপ করেনি! এই কথা শুনে মেয়েটিকে যারা হত্যা করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, তারা কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপরে স্থান ত্যাগ করে চলে গেল। বেঁচে গেল অসহায় মেয়েটি। এই গল্পের মধ্যে দিয়ে যে শিক্ষা আমরা পাই তা হল পাপহীন কোন মানুষ এই পৃথিবীতে নেই। মাতৃজঠরে জন্ম নেওয়া মানুষ পাপের বীজ উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করেই জন্ম নেয় এই পৃথিবীতে! ‘অপাপবিদ্ধ’ কথাটা অভিধানে পাওয়া যায়, উচ্চারণ করলে মনের ভেতরে বেশ একটা আনন্দ পাওয়া যায় কিন্তু এইটুকুই। একমাত্র ‘স্বয়ম্ভূ’ অর্থাৎ নিজে নিজেই এই পৃথিবীই পবিত্রতম। পাপের লেশমাত্র এই পৃথিবীকে স্পর্শ করতে পারেনা। তাই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কোন মন্দির, মসজিদ, গীর্জা যেখানে আছে, সেই স্থান যেমন পবিত্র ধর্মীয় স্থা্ন ঠিক তেমনিই পৃথিবীর প্রত্যেকটি স্থান পবিত্র। আমাদের শরীর যখন একেবারে সুস্থ থাকে, আমাদের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই আমরা খুব সহজেই সঞ্চালন করতে পারি, তখন আলাদা করে কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেই আমরা গুরুত্ব দিইনা বা পবিত্র ভাবি না। কিন্তু যখন রোগে, আঘাতে বা দুর্ঘটনায় কোন অঙ্গ বিকল হয়ে যায়, তখনই আমরা বুঝি সেই অঙ্গের মাহাত্ম্য। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোনটা পবিত্র, আবার কোনোটা অপবিত্র- কোন যুক্তিতেই এ কথা সত্যি হতে পারে না। শরীর পবিত্র বলেই শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই পবিত্র। ঠিক সেইভাবেই সমগ্র পৃথিবীই শুধু পবিত্র নয় — পবিত্রতম।
নেই যার কোন রাগ
কোন প্রত্যাশা
নেই যার কারো কাছে
এতটুকু আশা
ভালোবাসো মন্দবাসো
সে উদাসীন
নিজের কাজের মাঝে
বিপুল বিলীন
একমাত্র পৃথিবীই
অপাপবিদ্ধ
এ কথাই শেষ কথা
আর স্বতঃসিদ্ধ
এটা শুধু লেখার জন্য লেখা নয়। এটা শুধু একটা কবিতা নয়। এটা তার থেকে অনেক বেশি কিছু। এটা এই পৃথিবীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার সময় বহু মানুষের উদাহরণ টেনে নিয়ে আসি কিন্তু উপকার, ত্যাগ, দান, সহিষ্ণুতা ও সততার একমাত্র উদাহরণ এই পৃথিবীই। আদর্শ বৈষ্ণবের জীবন যেমন হওয়া উচিত তা বর্ণনা করতে গিয়ে বৈষ্ণব কবি বলেছেন-
তৃণাদপী সুনীচেন
তরোরপি সহিষ্ণুনা
অমানীনা মান দেয়ঃ
কীর্তনীয়ঃ সদা হরি
অর্থাৎ ঘাসের থেকেও নিজেকে হীন ও নীচ বলে মনে করো, গাছের থেকেও সহিষ্ণু হও। তুমি তেমন লোককেও মর্যাদা দাও যে মান পাওয়ার যোগ্য নয় আর সর্বদা হরি অর্থাৎ ভগবানের নাম করো। জীবনযাত্রা এক অতি উচ্চ আদর্শ সন্দেহ নেই কিন্তু এই কথা বলার সময় কবি যে তৃণের কথা বলেছেন তারও তলায় থাকে এই পৃথিবীর মাটি আর সুবিশাল বৃক্ষকে ধারণ করে এই পৃথিবীই। আর প্রত্যেক প্রাণীকে পৃথিবী মান দেয়, শুধু মানুষকে নয়। একটি ছোট ছোট পিঁপড়েও পরম আনন্দে আর নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায় এই পৃথিবীর বুকে। তাকে পিষে আমাদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে মেরে ফেলি আমরাই। অর্থাৎ আদর্শ জীবনযাত্রা কেমন হবে, কেমন ভাবে আমাদের চলা উচিত তার উদাহরণ দিতে গিয়ে সবার আগে এবং একমাত্র যার কথা আমাদের মনে আসা উচিত সেই পৃথিবী। বাংলার এক গীতিকার রচনা করেছিলেন অতি সুন্দর এক গান-
মাটিতে জন্ম নিলাম
মাটি তাই রক্তে মিশেছে-
আহা, বড় সুন্দর এই ভাবনা! এই মাটির ঋণ। এই পৃথিবীর ঋণ রক্তের মধ্যে বহন করেই তো জন্মাই আমরা, অথচ বেড়ে ওঠার সাথে সাথে অন্যান্য শিক্ষায় এত বেশি শিক্ষিত হয়ে উঠি যে এ জীবনে পৃথিবী- শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠা আর আমাদের হয় না! সকালে ঘুম থেকে উঠে আর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে এবং এছাড়াও দিনে রাতে বহুবার আমরা যে কোন মানসিক অবস্থায় থাকি না কেন ইষ্টদেবতার নাম নিয়ে থাকি, তা সে আমরা যে ধর্মেই বিশ্বাস রাখি না কেন! কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখি না যে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের সুযোগই যদি না পেতাম, তাহলে আমাদের পরম পূজ্য দেবতার বা গুরুর নাম জপ করতাম কিভাবে! আমাদের বাবা- আমাদের জন্ম দিয়েছে, তাও কিন্তু এই পৃথিবীর বুকে, তাকে অবলম্বন করেই! মাতৃ-ঋণ, পিতৃ-ঋণের সাথে এই পৃথিবী-ঋণেও কি আমরা সমানভাবেই ঋণী নই ! আমাদের বাবা- মায়ের ঋণ যেমন শোধ করা যায় না, পৃথিবীর ঋণও কি কোনভাবেই শোধ হয়? তবু বাবা-মায়ের ঋণের কথা আমরা কোনো কোনো সময় হয়তো স্বীকার করি, কিন্তু পৃথিবীর ঋণের কথা? কক্ষনো না। সবথেকে বেশি কৃতজ্ঞ যে এই পৃথিবীর প্রতিই থাকা উচিত, এই শিক্ষা আমাদের দেওয়া হয় না! যে সম্মান সবার আগে পৃথিবীর প্রাপ্য, সবার পরেও সে কথা মনে আসে না! তাহলে কি করে আমরা বিনম্র, সহিষ্ণু জীবন যাপন করব? কিভাবে সবাইকে সম্মান দেওয়ার কথা ভাববো! ইংরেজিতে একটা কথা আছে-চ্যারিটি বিগিন্স অ্যাট হোম কিন্তু আমার মতে তারও আগে চ্যারিটি সুড বি লার্নড ফ্রম হোম অর্থাৎ এই পৃথিবী, যা আমাদের প্রকৃত আবাসভূমি, দয়ার প্রথম পাঠ আমাদের নেওয়া উচিত সেই পৃথিবী থেকেই।
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক এবং অন্যান্য জ্ঞানীগুণী প্রচুর মানুষ দেখতে পাওয়া যায় এই পৃথিবীর বুকে কিন্তু পৃথিবী-জ্ঞানে জ্ঞানী মানুষের দেখা মেলে না ! বিজ্ঞান কথার অর্থ যদি বিশেষ জ্ঞান হয়, তাহলে পৃথিবী-জ্ঞান তো বিশেষতম জ্ঞান। পৃথিবী পবিত্রতম, তাই তার ভালোবাসাও বড় পবিত্র আর স্বার্থশূন্য। এই বিশেষতম জ্ঞান যদি কিছুটাও আমরা অর্জন করতে পারি, তাহলে আমরা প্রত্যেকেই অনুভব করবো যে এই পৃথিবীকে ভালোবাসার প্রাথমিক পাঠটুকু অর্জন করতে পেরেছি, বাকি জ্ঞানলাভ তো অতি সহজেই হবে। তখন আমরা নিজেরাই বুঝতে পারব সমগ্র পৃথিবীই যখন পবিত্র, তখন তার কোন খন্ড, ক্ষুদ্র অংশ আলাদা করে পবিত্র বলে অভিহিত হতে পারে না। ধর্ম অর্থাৎ যা ধারণ করে! পৃথিবী আমাদের এই শরীরকেই যে শুধু ধারণ করে তা তো নয়, আমাদের সমগ্র কাজের ভারও যে সেই বহন করে। সে যে অতি গুরুভার! সেই ভারের এক বিন্দুও আমরা লাঘব করতে পারবো না, চিরন্তন সত্য; কিন্তু একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো করতে পারি, তাতেও এত অনীহা কেন। অতি সহজ সত্য তো এই কথাই যে এই পৃথিবীই সর্ব সহিষ্ণুতার প্রতীক, সর্ব ধর্মের ধারক কারণ পৃথিবী যদি না থাকতো তাহলে ঐ পবিত্র ধর্মস্থানগুলির অস্তিত্ব কোথায় থাকতো আর ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হতো কোথায় দাঁড়িয়ে, কিভাবে! সহিষ্ণুতা ও ভালোবাসা কি তা নিজেকে দিয়ে প্রমাণ দেয় পৃথিবী। আমার খালি মনে হয়, যদি পৃথিবী-ধর্মে দীক্ষিত হতে পারি আমরা তাহলেই সব ধর্ম সমান মর্যাদা পাবে, কোন ভেদাভেদ থাকবে না আর প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাবে সর্ব-ধর্ম-সমন্বয় কথাটা। এই সকালবেলা বসে বসে যখন আপনাদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি আমার অনুভূতিগুলো, আমার কথা, ঠিক সেই সময়েই আমার চলভাষে একটা বার্তা এল, যাকে আমরা বলি হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজ। পাঠিয়েছেন আমারই কোন প্রিয় মানুষ। প্রায়ই তিনি পাঠান এরকম নানান প্রভাতী বার্তা। আজকের বার্তাটি ছিল- হাজারবার ডাকলেও যিনি বিরক্ত হন না, তিনিই ঈশ্বর। অতি সুন্দর ভাবনা। আর এই বার্তাটা পড়েই আমার একটা কথা মনে এলো- ঈশ্বরকে আমরা প্রায় সবাই ডাকি, প্রার্থনা জানাই তাঁর কাছে, কিন্তু কখনো এই কথা তো আমাদের মনে আসে না, যে পৃথিবীর বুকের ওপর দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের কাছে আমাদের প্রাণের আকুতি জানাই সেই পৃথিবী সম্পর্কেও অন্ততঃ এইটুকু প্রার্থনা করি যে, হে ঈশ্বর, তুমি এই পৃথিবী কে ভালো রাখো, সুন্দর রাখো- এই পৃথিবী দূষণমুক্ত ও সুন্দর থাকলে আমরা ও আমাদের অনেক পরের প্রজন্মও সুস্থ, সুন্দর ও ভালো থাকবে, এই শুভ বোধটুকু আমাদের দাও। ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শোনেন, কখনো মঞ্জুর করেন আবার কখনো তা ক্যানসেল করে দেন আবার কখনো হয়তো বা কিছু আবেদনকে ওয়েটিং লিস্টে রেখে দেন তাঁর সময়মত দেখবেন বলে। কিন্তু পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে দাঁড়িয়ে দিন বা রাতের যে কোনো সময় কোনো একজন মানুষও যদি এই প্রার্থনাটুকু করেন, তাহলে আমি নিশ্চিত যে পৃথিবীর এত কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে সেই মহামহিম অলমাইটির কাছে সেই আবেদন ওয়েটিং লিস্টেও যাবে না আর ক্যানসেলড তো হবেই না, বরং মোস্ট আর্জেন্ট অ্যাপিল হিসেবেই তাঁর সামনে পরিবেশিত হবে। কেন জানেন? হবে এই কারণেই যে সেই আবেদন পত্রে বড় বড় করে লেখা থাকবে- রেফার্ড এন্ড রেকমেন্ডেড বাই বিউটিফুল মাদার আর্থ! এই স্ট্রঙ্গেস্ট রেকমেন্ডেশনের পর আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর হওয়াটা শুধুমাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা। আপনারা মিলিয়ে নেবেন আমার এই কথাটা। বিশ্বাসের শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে এই লেখা আমি লিখছি আর এতদিনের সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রিয় পাঠক, আপনারা তো কিছুটা হলেও চিনেছেন আমাকে আর আমার সাথে প্রবল উৎসাহে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন। আমিও আপনাদের অন্তর থেকে বিশ্বাস করেছি আর ভালোবেসেছি বলেই আমরা ভাগ করে নিচ্ছি আমাদের পারস্পরিক অভিজ্ঞতা।
অনেকদিন হয়ে গেল আমরা বাইরে। সেই কবে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম বলুন তো! সুখে, দুঃখে কখন যে নিবিড় হয়ে উঠেছে আমাদের সম্পর্ক আর কখন যে পাঠক-লেখক এর মাঝখানের এই হাইফেন মুছে গেছে, তা আমাদের কারোরই আর মনে নেই। আর তাই আমার খুব ইচ্ছে করছে আপনাদের নিয়ে যাই একবার সেইখানে যেখানে আমার ছোট্ট সেই বাগান-প্রাসাদে আপনাদের সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিল আমার দুটো কবিতার লাইন এই মুহুর্তেই একসাথে মনে পড়ছে। একটা বাংলা আর অন্যটা ইংলিশ। প্রথমে বাংলা কবিতার লাইনগুলো বলি-
কত রূপ স্নেহ করি
দেশের কুকুর ধরি
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া
কি অদ্ভুত এক আত্মপ্রত্যয়, আর নিজের দেশ, নিজের জন্মস্থানের প্রতি কি নিবিড় এক ভালোবাসা ফুটে উঠেছে লেখার মধ্যে! বিদেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ বা মহার্ঘ কিছুও স্বদেশের অতি তুচ্ছ কোন কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়, মর্যাদায় সমকক্ষ নয়, এ কথাই বলেছেন কবি। এই কবিতাটা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের ওপর একটা ছবি ভেসে উঠল! অনেক মাস পরে পরে যখন আমি বাড়ি ফিরি বাড়ির কাছে দুটো কুকুর থাকে লালু আর ভুলু। তারা এগিয়ে এসে মুখের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে ডাকে, যেন বলতে চায়- আবার অনেকদিন পরে এলে, ভালো আছো তো ! আমার বুকটা ভালোবাসায় ভরে যায়; পকেটে বিস্কুট বা অন্য কোন খাবার থাকলে দিই, না থাকলে দিই না! কিন্তু ওদের ব্যবহার একটুও পাল্টায় না! আনন্দে চোখে জল এসে যায়, ভাবি এই অবলা প্রাণী, এদের মধ্যেও কত ভালোবাসা, কত ধৈর্য, প্রত্যাশা কিছু নেই। এই পৃথিবীর কাছে অতি সামান্য হলেও তারা এইটুকু শিক্ষা গ্রহণ করেছে কিন্তু আমরা নই। নিজের মনেই এতদিন ধরে এই আফসোস পুষে রেখেছিলাম, কিন্তু আপনারা তো জানেনই আপনাদের সব কথা ভাগ করে নিতে না পারলে আমার শান্তি হয় না! এবারে আসি ইংলিশ কবিতাটার কথায়। বিখ্যাত কবি রবার্ট ফ্রস্টের একটা কবিতার শেষ দুটো লাইন এইরকম-
এন্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ
এন্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ
ছোটবেলায় পড়া এই কবিতাটার আর বাকি সব লাইন এমনকি কবিতাটার নামও আমি ভুলে গিয়েছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন এই দুটো লাইন এত ভাল লেগেছিল, এই দুটো লাইন ঘুরেফিরে আওড়াতাম, এখনো আওড়াই। ছোটবেলায় এই দুটো লাইনের মানে বুঝতাম না। কিন্তু আজ বুঝি। একটা মানুষ, জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত একটা মানুষ শ্রান্তি, ক্লান্তি নিয়ে যেতে চাইছে তার ডেস্টিনেশনে। যে আক্ষেপ করেছিলেন বাংলার মহান নট ও নাট্য নির্দেশক গিরিশ ঘোষ-
জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই
কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই
সেই একই শ্রান্তির সুর কোথাও মিলেমিশে এক হয়ে গেছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই কবির লেখায়। রবার্ট ফ্রস্টের এই লেখাটা মনে আসার পর আমার নিজের লেখা কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ছে। আমি জানি আপনাদের ধৈর্য অসীম। তাই এতক্ষণ ধরে আমাকে সহ্য করছেন, আর সেই ভরসাতেই আমার কবিতার লাইনগুলো উল্লেখ করছি-
সারাবিশ্ব ঘুরে
এবার ফিরতে চাই নিজের ঘরে
যেখানে গাছেরা
কথা বলে হেসে
যেখানে নদীর চর
জ্যোৎস্নায় মেশে
যেখানে মিলে গেছে
আমি আর তুমি
এই সেই নাটশাল
পৃথিবীর পবিত্রতমভূমি
হ্যাঁ। এই সেই নাটশাল! আমার নাটশাল! এই পবিত্র পৃথিবীর একখন্ড পবিত্র প্রতিরূপ। ছোটবেলায় বর্ষার সময় মাঠে খেলতে গিয়ে যখন পা পিছলে পড়ে যেতাম, তখনও বড় বড় ঘাস আর মাটি যেন আদর করে কোলে টেনে নিত! খুব মজা লাগতো! আবার উঠতাম আবার পিছলে পড়ে যেতাম ইচ্ছে করেই। বড় মন কেমন করা দুপুর আর বিকেল ছিল সেগুলো! গরমকালের পড়ন্ত বেলায় গাছের তলায় গিয়ে বসতাম, কেন, এখনো বসি; আর বসার পরেই এমন মৃদু একটা হাওয়া বইতে থাকে, গাছের পাতায় পাতায় হাওয়ার বয়ে যাওয়ায় এমন একটা খস্খস্ খস্খস্ করে আওয়াজ হয়, মনে হয় গাছেরা তাদের নিজেদের সাথে কথা বলছে। দু’চারটে পাতা যখন আমার চারপাশে খসে পড়ে, এমনকি আমার গায়েও, তখন মনে হয়, ওরা আমার কুশলসংবাদ জানতে চাইছে। আমাদের গ্রামের গা ঘেঁষে গেছে রূপনারায়ণ নদ। এই রূপনারায়ণ নদের সঙ্গে আরও দুটি নদী এখানে মিশেছে। যেন তিনটি উজ্জ্বল যুবক-যুবতীর ইচ্ছা হয়েছে পরস্পরের সাথে দেখা করবে। তাই তারা এখানে এসে মিলিত হয়েছে আর তাদের হই হুল্লোরে, খুশিতে মাতিয়ে তুলেছে চারিদিক। সেই ছোট্টবেলা থেকেই দেখে আসছি নদীর রূপ কিন্তু এখনো যতবার দেখি, ততবারই মনে হয় এই প্রথম দেখছি নদী। এই জীবনে দেশে-বিদেশে কত নদী দেখেছি, তাদের কেউ শান্ত, গভীর আবার কেউ বা উদ্দাম। কিন্তু এই নদী দেখলে আমার আজও সেই ছোট্টবেলার মতই রোমাঞ্চ হয়! একটু বেশিই যেন সুন্দর লাগে আমার নদীকে। হ্যাঁ আমার নদী! এই নদীর সাথে আমার নাড়ির টান! আমার বড় আপন ওরা! তাইতো আমি অনায়াসেই লিখে ফেলতে পারি-
আমার একটা নদী আছে
দুরন্ত আর মিষ্টি
আমার নদী মাঝে মাঝেই
চরম অনাসৃষ্টি।
হ্যাঁ, নদীর সেই অনাসৃষ্টির রূপও আমি দেখেছি। প্রায় প্রত্যেক বছরই বর্ষাকালে নদীর জল ফুলে-ফেঁপে ওঠে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় নদীর পাড়। ক্ষতি হয় ফসলের। আবার শীতকালে নদীর জল অনেকটা সরে যায়, নদীর বুকে জেগে ওঠে চর। ঘাসে ছেয়ে থাকে চর। মনে হয় পৃথিবী-মায়ের সবুজ পবিত্রতায় মোড়া ঐ চর যেন বিশ্বচরাচরের এক অতি ক্ষুদ্র সংস্করণ। নদীর পাড়ের অল্প অল্প কাদা মাড়িয়ে চলে যাই সবুজ চরে। পায়ে লেগে থাকে কাদা আর মনে লেগে থাকে চারপাশে জলের মাঝখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত জেগে থাকা চরের রূপ। চরের মাঝখানে বসে যখন জলের দিকে তাকাই, তখন নদীর জল সূর্যের আলোয় রুপোর রং নিয়ে আমার চোখে আলপনা আঁকে। নদী ঢেউ তুলে নৌকা চলে যায়, একটা- দুটো- তিনটে, আমি বসে থাকি। এইভাবে অনেকটা সময় চলে যায়। একসময় আমি শুয়ে পড়ি সবুজ ঘাসে। তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে। দেখি নীল আকাশের ফ্রেমে সাদা আকাশের ছবি। সারা গায়ে সুড়সুড়ি দেয় সবুজ ঘাস। আরামে চোখ বুজে আসে। চারপাশ থেকে কোন আওয়াজ আর কানে আসে না। ঠিক ঘুম নয়, আমি কিরকম আচ্ছন্ন হয়ে যাই। এইরকম একটা দিনেই হঠাৎ একটা কথা আমার মনে এলো- ‘পৃথিবী ও কলা বিপ্লব দিবস’। কেন এই কথাটা আমার মনে এলো তাও বলি আপনাদের। এইরকম চরে শুয়ে ছিলাম একদিন দুপুরে, ঘাস আর মাটির অদ্ভুত ঘন একটা গন্ধ ভেসে আসছিল নাকে, আর অনেক ফড়িং আর প্রজাপতির ওড়াউড়ি দেখছিলাম আমার চারপাশে। হঠাৎ করে দেখলাম, একটা বেশ বড়সড় প্রজাপতি আমার হাতে এসে বসলো। তার বড় বড় দুটো ডানা হাওয়ায় থির থির করে কাঁপছিল, আর বেশ নিশ্চিন্ত অনায়াসে প্রজাপতিটা বসেছিল হাতে। আমি খুব কাছ থেকে দেখছিলাম। প্রকৃতির কি আশ্চর্য সৃষ্টি! যেন অতি যত্নে অনেক সময় নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই ছোট্ট পতঙ্গকে। মাত্র কয়েক দিনেরই তো আয়ু এই ছোট্ট প্রজাপতির। তাতেও ওর সৌন্দর্য সৃষ্টিতে কোন কার্পণ্য করেননি পৃথিবী-মা। প্রকৃতিকে একেবারে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দিয়ে দিয়েছে। দেখছিলাম ভীষণ উজ্জ্বল দুটো হলুদ ডানা আর তাতে ছোট্ট ছোট্ট গাঢ় কাল ঝুটি আর একটা গাঢ় লাল রঙের রেখা। এই মুহূর্তে আমার কাছে সৌন্দর্যের পরম নিদর্শন এই প্রজাপতি। আমি খালি ভাবছি, পৃথিবী স্বয়ং কত বড় শিল্পী হলে তবে এই ছোট্ট পতঙ্গকে এমন ভুবন ভুলানো রূপে সাজিয়ে তোলা যায়! এমন রঙের কম্বিনেশন কিভাবে সম্ভব হলো! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর কোন শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব, এমন জীবন্ত শিল্প উপহার দেওয়া! এই কথা ভাবতে ভাবতেই আমার মুখ থেকে কিভাবে যেন বেরিয়ে এলো- এ তো ‘কলা বিপ্লব’। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই একথাও কেমন করে আমার মাথায় এলো আমি জানিনা, কারণ তার আগের মুহূর্তেও তো আমার মাথায় আসেনি! পৃথিবী-মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া এই কথা আমার মাথায় আসার কথাই নয়। সেই কথাটা হলো- পৃথিবীর জন্মদিন পালন করলে কেমন হয়! হ্যাঁ পৃথিবীর জন্মদিন পালন! কেন নয়! কোটিকোটি মানুষের জন্মদিন পালিত হচ্ছে এই পৃথিবীতে। তা সে অতি নামি দামী মানুষ থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সেই তালিকায় রয়েছে। তাহলে কোটি কোটি বছর ধরে এই পৃথিবী যে অনন্ত সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে আমাদের, তার কি এইটুকু প্রাপ্য হতে পারে না! হ্যাঁ, হতে পারে। পৃথিবীর জন্মদিন আমাদের জানা নেই! তাতে কি! বছরের কোন একটা দিনকে যদি আমরা পৃথিবীর জন্মদিন পালনের জন্য বেছে নিই, তাহলে পৃথিবী নিশ্চয়ই তার বার্থ সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে আসবে না! এই ভাবনাটা মাথায় আসার সঙ্গে আরও অনেক কথাই মনে এল। আচ্ছা, ‘পৃথিবী ও কলা বিপ্লব দিবস’ নাম দিয়ে যদি সেই দিন পৃথিবীর জন্মদিন পালন করি। শিল্প বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, শ্বেত বিপ্লব, সবুজ বিপ্লব- ইত্যাদি অনেক বিপ্লবের কথা আমি শুনেছি যেগুলোর সাথে মানুষের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। কিন্তু এই যে অপূর্ব সব প্রাকৃতিক সৃষ্টি, তার সাথে তো মানুষের কোন যোগাযোগ নেই, একেবারেই নেই। এই সৃষ্টির কৃতিত্ব একমাত্র পৃথিবীর। তাই ঐ দিনটার নাম রাখব- ‘পৃথিবী ও কলা বিপ্লব দিবস’। হ্যাঁ একেবারে ঠিক নামটা পেয়েছি। আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম। এইবারে ঠিক করতে হবে দিনটা! আসলে ঠিক করতে হবে বলছি বটে, কিন্তু আমি কিছুই ঠিক করছি না। অদৃশ্য কেউ যেন আমার সমস্ত ভাবনাটা নিয়ন্ত্রণ করছে। যাকে নিয়ে ভাবছি সে ছাড়া আর কে হবে! আচ্ছা, বছরের প্রথম মাস তো জানুয়ারি। তাহলে যদি জানুয়ারি মাসে এই অনুষ্ঠান করি তাহলে কেমন হয়? হ্যাঁ, তাই করবো। খুব ঝক্ঝকে আবহাওয়া থাকে, যদিও আবহাওয়া বা অন্য কোন সমস্যা নিয়েই আমার চিন্তার কোন কারণ নেই আমি জানি। কারণ এই পৃথিবীর বুকে যা কিছু ঘটে, তার নিয়ন্ত্রক এই পৃথিবী। একথা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তাহলে মাসটা তো ঠিক হলো। এবারে দিনটা। তাহলে- তাহলে, আচ্ছা, আচ্ছা, মাসের প্রথম দিক আর শেষ দিক বাদ দিয়ে মাঝামাঝি সময় করলে কেমন হয়! ঠিক, এই তো পেয়েছি। আচ্ছা, চোদ্দ তারিখ না পনেরো তারিখ! ঠিক আছে, পনেরো তারিখেই ‘পৃথিবী ও কলা দিবস’এ পৃথিবীর জন্মদিন পালন করব। তাহলে নামটা দেব - বার্থডে সেলিব্রেশন অফ আওয়ার বিউটিফুল মাদার আর্থ অন দি ‘আর্থ এন্ড আর্ট রেভোলিউশন ডে’। নামটা কি বেশি বড় হয়ে গেল? হোক, যাকে নিয়ে এই অনুষ্ঠান সেই তো বৃহত্তম! তার উপযুক্তই হয়েছে নামটা। এইবারে এই অনুষ্ঠান করার মত একটা উপযুক্ত জায়গা আমার দরকার। পরপর যেমন সবকিছুই মনে আসছে, তেমনি করেই বিদ্যুৎ চমকের মতই মাথায় চলে এল জায়গার নামটা। নাটশাল। হ্যাঁ, আমার নাটশাল। সম্ভবত এটাই পৃথিবী-মায়ের প্রিয়তম জায়গা। তাই এখানে জন্মানো আমার মত এক অখ্যাত সামান্য মানুষের মাথায় এই ভাবনা এল কেন আর পৃথিবী-মা আমার উপরেই বা এই গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দিলেন কেন! দিলেন কেননা এটাই তিনি চান। আর তিনি যা চান সেটাই যে হবে, এটাই তো স্বতঃসিদ্ধ। যাক, আস্তে আস্তে সমস্ত কাজ এগিয়ে চলেছে, কোন সমস্যাই আর সমস্যা থাকছে না। আমি শুধু একটা শিশুর মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি পৃথিবী-মা নিজের মতো করে গুছিয়ে নিচ্ছে সব কিছু। আমি বেশ কিছু মানুষের সাথে কথা বললাম, তারা এইরকম একটা অনুষ্ঠানের কথা জীবনে প্রথম শুনলেও, আমি খানিকক্ষণ এই বিষয়ে তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করার পরেই তারা এই বিষয়টায় বেশ উৎসাহিত হলেন এবং একেবারে অভিনব উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন। এসে গেল সেই দিনটা। পনেরোই জানুয়ারী। আগের দিন রাত থেকে আমার একটা, না ভয় নয়, অস্বস্তি কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল, এই অতি গুরুভার যা পৃথিবী- মা আমাকে দিয়েছে, তা আমি ঠিকভাবে সামলাতে পারবো তো! কিছুক্ষণ ভাবতে ভাবতেই আমার মনে হল, আরে, আমি এতো ভাবছি কেন? যার কাজ, তিনিই তো এই দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন, আমি পারবো সেটা জেনেই; আর রিমোট তো সর্বক্ষমতার উৎস, সেই পৃথিবীর হাতেই। তিনি চালিকাশক্তি, যেভাবে চালাবেন সেই ভাবেই চলবো। তারই হাতের যন্ত্র আমি, যেভাবে বাজাবে, সেই সুরেই বাজবো আমি। পনেরোই জানুয়ারি সকালটা অদ্ভুত সুন্দর হয়ে ধরা দিল আমার চোখে। আমাদের গ্রামের দিকে জানুয়ারির ঠান্ডা বেশ কড়া থাকে। সকালে উঠেই শিশিরে মুখ ধুয়ে, হিমেল হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে গাছেরা, সবুজ ঘাস আর মাটির গন্ধ মাখা আলপথেরা একেবারে প্রস্তুত হয়ে আছে আশ্চর্যতম এই উৎসবের সাক্ষী হবে বলে।
অনুষ্ঠান শুরু করলাম। স্টেজের ওপর মাইক্রোফোন হাতে আমি আর আমার সামনে অনেক চেনা মুখ আর বেশকিছু অচেনা মুখও রয়েছে। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই আমার আত্মীয়। কারণ আমরা প্রত্যেকেই এই পৃথিবীবাসী আর সেই সূত্রে পরস্পরের সাথে একসূত্রে গাঁথা, একই পরিবারের সদস্য। বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনায় শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান, আর এগিয়ে চলল আপন গতিতে। ঝরনার স্বচ্ছন্দ গতি নিয়ে। অনর্গল, অবাধ ভাব প্রকাশে আমি, উপস্থিত দর্শকের সাথে গড়ে তুললাম মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগ। আর তাদেরকে পৃথিবী সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন করতে শুরু করলাম কুইজের ধরণে। ভালো লাগলো এটা দেখে যে ছোটদের সঙ্গে বড়রাও দারুণ উৎসাহ নিয়ে এই প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিলেন। কিছু উত্তর পেলাম দর্শকদের মধ্যে থেকে। আবার কিছু প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়ে দিলাম। যারা বলতে পারলো, তাদের হাতে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা সামান্য কিছু উপহার তুলে দিল। এর ফাঁকে ফাঁকে চলছিল মঞ্চের উপরের অনুষ্ঠান! আর মঞ্চের ঠিক পেছনেই রাখা ছিল বিশাল এক পর্দা, আর সেই পর্দায় প্রতিফলিত হচ্ছিল শিল্পীদের সৃষ্টির অনন্য সব মুহূর্ত। পৃথিবীকে উপলক্ষ করে নাচ-গান-আবৃত্তি-নৃত্যানুষ্ঠানে সাজান হয়েছিল এই ভাবানোর অনুষ্ঠান। হ্যাঁ, সচেতন ভাবেই ‘ভাবানো’ শব্দটা লিখলাম কারণ আমার এই ভাবনাটাই আমি এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে দিতে চাইছি যে এই পৃথিবী আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বুকে আগলে রাখে, আর মৃত্যুর পর, যখন কেউ সঙ্গে থাকে না, এমনকি গর্ভধারিণী মা ও নয়, তখনো সে কিন্তু আমাদের কে তার বুকে মিশিয়ে নেয়। সেখানে ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের কোন পার্থক্য নেই। পাহাড়-নদী-ঝর্ণা-অরণ্য-সমুদ্র সহ এই যে সুবিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের ভোগ-উপভোগ করার জন্য সে উপহার দিয়েছে, কোন পাল্টা উপহারের প্রত্যাশা না রেখেই, তার জন্য এইটুকু করতে পারিনা আমরা! পারিনা বছরের একটা দিনকে তার জন্মদিন পালনের দিন বলে মর্যাদা দিতে! পারি না এই পৃথিবীকে দূষণমুক্ত পরিচ্ছন্ন রাখতে! পারি, নিশ্চয়ই পারি। আমাদের পারতেই হবে। পারতে হবে আমাদের নিজেদের জন্যই। দরকার একটু হুঁশ আর চেতনা। এই চেতনাটুকু মানুষের মধ্যে আনার চেষ্টাটুকুই আমি করছি। যাকে বলে সলতে পাকানোর কাজ, সেই কাজটুকুই আমি করছি। আমার উপর আমাদের পৃথিবী-মা এই দায়িত্বটুকু দিয়েছেন। আর কিছু না! একসময় শেষ হলো এই হৃদয় নিংড়ানো অনুষ্ঠান। শিল্পীদের মধ্যে একটা বিষয় লক্ষ্য করে আমার খুব ভালো লাগলো যে তাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের থেকেও যা অনেক বেশি বড় হয়ে দেখা দিচ্ছিল, তা হল তাদের নিষ্ঠা, ভালোবাসা আর পৃথিবীর প্রতি দায়বদ্ধতা। তাদের প্রত্যেকের পারফরম্যান্সে এই কথাটাই বারবার ফুটে উঠেছিল যেকোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়, এই অনুষ্ঠান তার জন্য, যে আমাদের ধারণ করে আছে বলেই আমাদের শিল্প-সৃষ্টি-কৃষ্টি-সংস্কৃতি আমরা তুলে ধরতে পারছি। তাই এই ‘পৃথিবী ও কলা বিপ্লব’ যে আমাদের পৃথিবীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দিন, একথা তাদের প্রত্যেকের পদক্ষেপে ফুটে উঠছিল। স্টেজ থেকে নামার পর উপস্থিত মানুষদের কাছ থেকে যে আন্তরিক উচ্ছ্বাস ও অভিনন্দন পেলাম, তা আমাকে একই সঙ্গে আপ্লুত ও উৎসাহিত করল। আমার এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য সামান্য হলেও সফল বলে আমার মনে হল। আমার তো সবসময় মনে হয়, আমরা প্রতি মুহূর্তেই আমাদের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, সফল হওয়া বা না হওয়া এবং আরো নানাবিধ সমস্যার জটিল আবর্তের মধ্যে ঘুরেই চলেছি। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি এই ধরিত্রী-মা যিনি আমাদের শুধু দিয়েই চলেছেন বিন্দুমাত্র প্রত্যাশা না রেখেই, অথচ আমরা সারা পৃথিবী জুড়ে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে শুধুমাত্র আমাদের খেয়াল খুশি চরিতার্থ করার জন্য ধ্বংস করে চলেছি পৃথিবীর বিপুল প্রাকৃতিক, খনিজ ও বন সম্পদ। তাহলে কতখানি অভিমান ও কষ্ট জমে রয়েছে তার বুকে, তা কি একবারও ভাবি! একবারও কি আমাদের কৃতকর্মের জন্য দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চাই, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি কি! মহৎ কাজ করার জন্য সারা বিশ্বের সব দেশেই সেই মানুষটিকেই ‘গার্ড অফ অনার’ দেওয়ার প্রথা রয়েছে। অতি যুক্তিসঙ্গত এই প্রথা কিন্তু মহত্তম কাজের জন্য এই পৃথিবীকে, যিনি আমাদের সর্বার্থেই বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাকে তো পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রতিদিন একবার করে গার্ড-অফ-অনার দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, এবং সেটা আমাদেরকেই ধন্য করবে, কৃতজ্ঞ করবে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে আমার বন্ধু, কবি ও ঔপন্যাসিক ঋদেনদিক মিত্রো, যে আমার ভাবনাকে খুব সম্মান করে, তার ভাষায়, ‘মাতা এমন কারোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যে তার চোখের জল মোছাবে চিরকালের জন্য’। তার এই কথার জন্য, তার গভীর অনুভূতির জন্য তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ২০১৫ সালের একত্রিশে অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটা প্রমোশানাল অনুষ্ঠান হল এই বিষয় নিয়েই। আসলে বেশ কয়েক বছর অস্ট্রেলিয়ায় থাকার সূত্রে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু রয়েছেন সিডনিতে এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন আমার এই ভাবনার শরিক। তাদের উদ্যোগ ও আন্তরিক আগ্রহেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হয়েছিল।
এই অনুষ্ঠান আমাকে নতুন নতুন ভাবনার খোরাক যোগালো! আমি ভাবতে শুরু করলাম, এই পৃথিবীতে যুগে যুগে অসংখ্য মানুষের মূর্তি তৈরি হয়েছে, বছরের কোন নির্দিষ্ট দিনে সেই গোষ্ঠী বাা সম্প্রদায় অথবা সেই দেশের মানুষ সেই মূর্তির প্রতি সম্মান দেখায়। যিনি সর্বজীবের ধারক ও বাহক তার কোন মূর্তি সেইভাবে তৈরি ও প্রতীকের কথা তো চিন্তা করা হয়নি। তেমন মূর্তি তৈরি করতে হবে। হ্যাঁ, আর সময় নেই। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। এমন স্ট্যাচু তৈরি করতে হবে যার সামনে মাথা নত করবে সারা বিশ্বের সব মানুষ, যেখানে জাত-পাত, ধনী- দরিদ্র, ছোট-বড়, গোষ্ঠী সম্প্রদায় বা সাদা-কালোর কোন বিভেদ থাকবে না। প্রিয় পাঠক, আপনারা তো স্ট্যাচু অফ লিবার্টি আর আইফেল টাওয়ার - এই দুটির সাথেই পরিচিত। এই দু’টির মর্যাদা সারা পৃথিবী জুড়েই একটু আলাদা। ফ্রান্সের এই আইফেল টাওয়ার কে আদর করে আয়রন লেডি বলে ডাকা হয়। পাঁচ বিলিয়ন আলো রয়েছে এই আইফেল টাওয়ারে। এই টাওয়ারের প্রথম প্ল্যাটফর্মটি মাটি থেকে একশ নব্বই ফুট উঁচুতে অবস্থিত, দ্বিতীয় প্ল্যাটফর্মটি তিনশো ছিয়াত্তর ফুট উঁচুতে এবং তৃতীয় প্ল্যাটফর্মটি মাটি থেকে নশো ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এই বিশাল টাওয়ার বিপুল আর অতি উচ্চতার জন্যে সম্ভ্রম জাগায়। একটা সমীহ ভাব আসে মনের মধ্যে। আইফেল টাওয়ারের সামনে দাঁড়ালে নিজেকে কীট পতঙ্গের মতো মনে হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন আইফেল টাওয়ার দেখার জন্য ভিড় করে।
এবারে আসা যাক স্ট্যাচু অফ লিবার্টির কথায়। ১৮৮৬ সালে আমেরিকায় বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের পক্ষ থেকে এই মূর্তিটি উপহার দেওয়া হয় সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসাবে। শত বছরেরও অধিক সময় ধরে এই স্ট্যাচু, ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
এই আলোচনার মধ্যে আইফেল টাওয়ার এবং স্ট্যাচু অফ লিবার্টির প্রসঙ্গ এই কারণেই আনলাম যে এই আইফেল এবং স্ট্যাচু অফ লিবার্টি- যে যে দেশে রয়েছে সেই ফ্রান্স ও আমেরিকার গর্ব এই টাওয়ার এবং স্ট্যাচু। মুনশিয়ানা, বৈভব এবং বিপুলত্ব - সমীহ জাগায়। কিন্তু আমার ভাবনার এবং কল্পনার ‘স্ট্যাচু অফ মাদার আর্থ’ বা ‘পৃথিবী মায়ের মূর্তি’র সাথে এদের কোন তুলনা হয়না। কারণ এই স্ট্যাচু অফ মাদার আর্থ তো পৃথিবীর সব মানুষের গর্বের কারণ হবে। এই স্ট্যাচু দেখলে সম্ভ্রম বা সমীহ জাগবে না! এই স্ট্যাচু দেখলে ভালোবাসায় বুক ভরে যাবে প্রতিটি মানুষের, আবেগে চোখের কোনায় জল চলে আসবে। সর্বংসহা এই ধরিত্রী মায়ের স্ট্যাচু আবেগের দরজায় কড়া নাড়বে মানুষের। এই মা যে আমাদের সবার মা, তা মানুষের অনুভূতিতে ঢেউ তুলবে। এই স্ট্যাচু হবে সর্বকালের, সর্ব দেশের, সব মানুষের। স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটি মানুষের মনে হবে, হতে পারে সে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান বা ভারতবর্ষ- যে কোন দেশের নাগরিক। কিন্তু এখন থেকে সে সবার আগে এই পৃথিবীবাসী, আর বাকী সবকিছু তার পরে। এই স্ট্যাচু মানুষকে দেবে পৃথিবীকে ভালোবাসা ও রক্ষা করার ভাবনা! এই পর্যন্ত ভাবার পরেও আমার মনটা কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগলো। মনে হল, এই পৃথিবীর মানুষকে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানাবে এই পৃথিবী। তাহলে তো তারও কিছু চাই, আরো কিছু চাই! গভীর ভাবনায় ডুবে গেলাম আমি। তারকার পর্দায় যেমন ছবি ভেসে ওঠে, তেমনি করেই পাঁচটা ভাবনা ভেসে উঠলো আমার মনের পর্দায়। আর আমি খাতা পেন টেনে নিয়ে লিখতে বসলাম-
১. সবার উপরে পৃথিবী সত্য।
২. ভালবাসাই একমাত্র পথ…………
৩. আমাদের গর্ব হওয়া উচিত, আমরা পৃথিবীবাসী।
৪. মাতৃভূমির সেবা করাই, ঈশ্বরের সেবা করা।
৫. আসুন আমরা এই পৃথিবীকে শ্রদ্ধা জানাই।
লেখা শেষ হওয়ার পরে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। বুকের ভেতরটা কেমন করছে! নিজের মনকে বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে। আমি এই ভাবনাগুলো ভেবেছি! আমি! না, আমি নিশ্চিত এর পেছনে কোন বিপুল শক্তি কাজ করছে! কোনো শক্তি বলছি কেন, যে পৃথিবী-মাকে নিয়ে এই ভাবনা-চিন্তা, পেছন থেকে তিনিই আমায় ক্রমশ আরো আরো সামনে ঠেলে দিচ্ছেন। আমার এই অতি সীমিত ক্ষমতায়, এই বিশ্বব্যাপী ভাবনায় বিশ্ববাসীকে সামিল করা, একত্রিত করা বড়ই কঠিন। তাই আমি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অনেক রাষ্ট্রনেতা, বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, সেলিব্রিটি, নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্বও রয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন অতি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব নোবেল পুরস্কার জয়ী ‘শান্তির দেবদূত’ মহামান্য দলাই লামা। তাঁর কথা আজ খুব মনে পড়ছে। তিনি একটি আশীর্বাদী চিঠিতে জানিয়েছিলেন, “বিশ্বের মানুষকে একতায় নিয়ে আসার যে প্রয়াস আপনার, তার জন্য আমার তরফ থেকে সমস্ত শুভ ইচ্ছে বর্ষিত হোক আপনার প্রতি”। এই চিঠি আমার মনোবল ও উৎসাহ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কথা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আমার খুব ভালো লাগছে। জাতিসংঘের প্রেসিডেন্ট স্যার আন্তোনিও গুতেরস আমার চিঠির জবাবে চিঠি পাঠিয়ে আমার এই ভাবনা ও উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে আমার পদক্ষেপ ঠিক কি হওয়া উচিত তাই নিয়েও আমাকে একটা চিঠি দেন। আরও অনেক রাষ্ট্রনেতা আমাকে চিঠি দিয়ে এই উদ্যোগের সাফল্য কামনা করেছেন। তাঁদের প্রত্যেকের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি আগে অনেকবার ভেবেছি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার একটি অখ্যাত অংশে জন্মানো আমার মাথায় পৃথিবীকে নিয়ে এই সমস্ত ভাবনা এলো কিভাবে এবং পৃথিবীর জন্মদিন পালনের মত অতি পবিত্র একটি ব্যাপার এই নাটশালেই বা সংঘটিত হলো কিভাবে! ভাবতে ভাবতে একসময় আমার মনে হল এটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। হতে পারে এর আগে প্রচুর মানুষ নানা দিক দিয়ে পৃথিবী কে নিয়ে ভেবেছেন, কিন্তু সেই ভাবনাটা ছিল হয়তো আংশিক, আমার ভাবনার মধ্যে সমগ্র পৃথিবীকে নিয়ে ভাববার মতো হয়তো একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রকাশ পেয়েছে। সেই কারণেই যাকে নিয়ে আমার এই ভাবনা, হয়তো তিনিই চেয়েছেন, হয়তো কেন, নিশ্চিতভাবেই চেয়েছেন এই অতি তুচ্ছ একটি ভূখণ্ডেই পালিত হোক ‘পৃথিবী ও কলা বিপ্লব দিবস’ এবং পালিত হোক তাঁর অর্থাৎ আমাদের পৃথিবী-মায়ের জন্মদিন। তাই পবিত্রতম এই পৃথিবীতে নাটশালকেই পৃথিবী-মা পবিত্রতম ভূমি বলে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন বলে প্রথমটা আমার মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে পরে আমার মনে হয়েছে- একটা কথা আছে- হিউম্যান বডি ইজ দ্য টেম্পল অফ লিভিং গড- অর্থাৎ এই আমাদের রক্ত মাংসে গড়া শরীরই জীবন্ত ঈশ্বরের আবাসভূমি। তার মানে আমাদের এই সমগ্র শরীরটাই অতি পবিত্র কারণ পবিত্রতম ঈশ্বর এখানেই বিরাজ করেন। আমাদের এই শরীরের, রক্ত, মাংস, শিরা, ধমনী- সবই অতি পবিত্র! কারণ ওই যে বললাম, সমস্ত শরীরই তো পবিত্র, তাই, হা্ত, পা, মাথা, চোখ, নাক, মুখ, কান- এই যে সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এই সবও অত্যন্ত পবিত্র! কারণ সমগ্র যদি অতি পবিত্র হয়, তাহলে তার খন্ড খন্ড অংশও অতি পবিত্র। খুব সহজ হিসেব এটা। তাই এই নাটশাল পবিত্রতম ভূমি। কারণ পবিত্রতম পৃথিবীর এক অতি ক্ষুদ্র অংশ! আর আগেই তো প্রমাণ হয়ে গেছে, সমগ্র যখন পবিত্রতম, তখন অংশও পবিত্রতম হতে বাধ্য। আজ একেবারে বইয়ের শেষ অংশে এসে আমার ভাবনাটা একটা অন্য খাতে বইছে; এই নাটশাল থেকে উঠে আসা ভাবনা যদি ক্রমে ক্রমে সারা পৃথিবীর একেবারে কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ে তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়! প্রিয় পাঠক-বন্ধুরা, আমি জানি আপনারা বলবেন, তার থেকে ভালো কিছুই আর হয় না। ঠিকই বলেছেন, সেটাই হতে হবে। হতে হবে, আমাদের নিজেদের জন্য, নিজেদের স্বার্থে। একটু একটু করে এই ভাবনাগুলো, যে ভাবনার প্রিয় শরিক আজ থেকে আপনারাও, সেই ভাবনাগুলোকে মানুষ যখন আপন করে নেবে, পৃথিবীর কোনায় কোনায় যখন দেখা যাবে এই ভাবনার প্রতিফলন, পৃথিবীকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য,প্রাকৃতিক মূল্যবান সম্পদ ও সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য নিজেদের সময় ও শ্রমের কিছুটা অংশ ব্যয় করবে, তখন ক্রমশঃ পবিত্রতম পৃথিবীর যত খন্ড খন্ড অংশ তাও ধীরে ধীরে পবিত্র ভূমিতে পরিণত হবে। তখন, নদী, নালা, খাল, বিলের জল সমুদ্রে গিয়ে মিশলে সবটাই সমুদ্রের জল হয়ে যায়, আলাদা কোনো অস্তিত্ব তাদের থাকে না। ঠিক তেমনি সমগ্র পৃথিবীই হয়ে যাবে পবিত্রতম ভূমি। তখন আলাদা করে পৃথিবীর কোন ভূখণ্ডই কম পবিত্র, বেশি পবিত্র থাকবে না। যা হবে তা হল-
মিলে যাবে মিশে যাবে
থাকবে না আলাদা জমি
এক ঐকতানে মিশে যাবে
পবিত্রতম পৃথিবীর পবিত্রতম ভূমি।
আর সেইদিন আমার সেই স্বপ্নটা সত্যি হয়ে যাবে। সেই যে বলেছিলাম না, আমি চরে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, এই চরটা বিশাল চরাচরের অতি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ! সেই পবিত্র চর, পবিত্রতম চরাচরে মিশে পবিত্রতম হয়ে যাবে, তার বেশি আমার চাওয়ার কিছু নেই!
- সমাপ্ত -