।। সপ্তম।।

অনেকটা ঘুরে। অনেকটা দূরে। কিংবা হয়তো কাছাকাছি। অতি উচ্চ স্ট্যাচু অথবা অতি উচ্চ কোন সৌধ। এর কোন একটা যখন দেখি, তখন দেখতে ভালো লাগে! আর সেই সঙ্গে মনে মনে ভাবতে থাকি, কি বিপুল শ্রম, অধ্যবসায়, সময় ও অর্থ খরচে তৈরি হয় এই সমস্ত সুউচ্চ সৌধ ও স্ট্যাচুগুলি। সারা বিশ্বে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে এই ধরনের স্ট্যাচু ও সৌধ। চলছে উচ্চতায় পরস্পরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা আর আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা। বইয়ের এই স্বল্প পরিসরে, সেই রকম সুউচ্চ স্ট্যাচু ও সৌধের কয়েকটি নিয়েই আমরা আলোচনা করব। এদের মধ্যে প্রথম যে স্ট্যাচুটিকে নিয়ে আমরা আলোচনা করব সেটি হল স্ট্যাচু অফ্ ইউনিটি। ভারতবর্ষের গুজরাট শহরে কেভাডিয়া কলোনিতেএই স্ট্যাচুটি নির্মাণ করা হয়েছে। যে বেদির উপরে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত, সেই বেদীর থেকে নিয়ে মূর্তির পূর্ণদৈর্ঘ্য সাতশো নব্বই ফুট। স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর যোদ্ধা এবং ভারতবাসীর কাছে লৌহমানব বলে খ্যাত সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল এর এই অতিকায় মূর্তিটি তৈরি করা হয়, তাঁর প্রতি ভারতবাসীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য। এই মূর্তি তৈরি করেন শিল্পী রাম. ভি. সুতার। মূর্তিটির নির্মাণ নৈপুণ্য এমনই যে শ্রদ্ধেয় লৌহমানবের  দৃঢ়চেতা মনোভাবটি যেন এই মূর্তির মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। স্বাধীন ভারতবর্ষের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মূর্তিটি আমেরিকার স্ট্যাচু অফ লিবার্টির তুলনায় উচ্চতায় প্রায় চারগুণ বড়। স্বাধীন ভারতবর্ষের মানুষের কাছে এই মূর্তিটি ঐক্যের প্রতীক, ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই ও জয়ের প্রতীক, তাই এই মূর্তির নাম দেওয়া হয়েছে স্ট্যাচু অফ্ ইউনিটি। বর্তমানে পৃথিবীর উচ্চতম মূর্তি এই স্ট্যাচু অফ ইউনিটি।


এইবারে দ্বিতীয় যে মূর্তিটি নিয়ে আমরা আলোচনা করব, সেটি অবস্থিত উসিকু ইবারাকি অফ্ জাপান। জাপানের উক্ত অঞ্চলে গৌতম বুদ্ধের একটি অতি সুন্দর মূর্তি রয়েছে। মূর্তির সর্বসমেত ওজন চার হাজার টন। একটি সুবিশাল পদ্মের উপর এই মূর্তিটি দাঁড়িয়ে। কথিত আছে এই স্থানেই গৌতম বুদ্ধ মহাজ্ঞান লাভ করেছিলেন। পৃথিবীর নানা প্রান্তে বুদ্ধমূর্তি রয়েছে অনেক। প্রত্যেকটি মূর্তিই তাদের স্বকীয়তায় এবং বৈশিষ্ট্যে উজ্জল। এই মূর্তিটিও তাদের অন্যতম।


এইবারে যে মূর্তিকে নিয়ে আসবো আমরা আমাদের আলোচনায়, সেটি হল পিটার দ্য গ্রেট স্ট্যাচু। রাশিয়ার মস্কোতে অবস্থিত এই স্ট্যাচুটির উচ্চতা তিনশ বাইশ ফুট। রাশিয়ান নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠাতা পিটার দি গ্রেট-এর সম্মানে তাঁর এই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় রাশিয়ান নৌবাহিনী তিনশোতম প্রতিষ্ঠা দিবসে। এই মূর্তির ওজন এক হাজার টন। এরমধ্যে ছ’শো টন সলিড স্টেনলেস স্টিল আর বাকিটা তামা আর ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি। এই বিতর্কিত মূর্তিটি জনগণের ভোটের বিচারে বিশ্বের দশম কুৎসিত মূর্তির আখ্যা পায়।


অনেক মূর্তির মধ্যে আমরা মাত্র তিনটে মূর্তির বিষয়ে আলোকপাত করলাম, যা এই পৃথিবীতে বর্তমানে মানুষের তৈরি মূর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও সারা পৃথিবী জুড়ে আরো অনেক সুউচ্চ স্ট্যাচু ও সৌধ রয়েছে, যা তাদের স্থাপত্য, নৈপুণ্য ও ভাবনার বিচারে আমাদের মুগ্ধ করে। এই স্ট্যাচুগুলির প্রত্যেকটিরই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে। আমাদের আলোচনার পরিমণ্ডলে হয়তো এই সমস্ত সৃষ্টি সম্ভারকে নিয়ে আসা সম্ভব হলো না, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য, পৃথিবীর উচ্চতম স্ট্যাচু ও সৌধ নিয়ে আলোচনায় যে কোনো সময় এই সমস্ত অনন্য সৃষ্টি অনায়াসেই জায়গা করে নেবে। তাই আমরা দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ না থাকার দরুণ আরও তিনটি পৃথিবী বিখ্যাত উচ্চতম স্ট্যাচু ও সৌধের নাম এখানে আমার প্রিয় পাঠকদের জন্য উল্লেখ করলাম। এই স্ট্যাচু ও সৌধগুলি হল- চীনের স্প্রিং টেম্পল অফ বুদ্ধ, লেকিউন সেক্ক্যা বুদ্ধ অফ মায়ানমার, গ্রেট বুদ্ধ অফ থাইল্যান্ড। এই স্থাপত্যগুলির প্রত্যেকটিই মহান ভাবধারার সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। আগ্রহী পাঠক, এই সম্বন্ধে আরও বিশদে জানার জন্য যদি এই লেখা দ্বারা অনুপ্রাণিত হন, তাহলেই এই প্রচেষ্টাটুকু সার্থক বলে মনে করবো।    এক একটি দেশে এক একজন মানুষ এমন কিছু স্মরণীয় কীর্তি স্থাপন করেন, সেই দেশের মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে যায় সেই বিশেষ মানুষটির নাম। বীরের সম্মান পান তাঁরা এবং সেই দেশের মানুষের কাছে তাঁরা হয়ে যান জাতীয় নায়ক। এইসব মূর্তি জাতির ও দেশের শ্রদ্ধার্ঘ্য সেই মানুষের প্রতি। তাঁদের নামে সেই দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সৌধের নামকরণ করা হয়।এছাড়াও রাস্তা, পার্ক, বিমানবন্দর, রেল স্টেশন এবং আরো অনেক কিছুর সাথে জড়িয়ে থাকে সেইসব মানুষের নাম। এ অত্যন্ত যথাযথ একটি কাজ। কারণ, এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে, শিল্পবিপ্লবে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবে এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক উদ্যোগে যারা অনন্য স্বাক্ষর রেখে গেছেন, এই সম্মান, শ্রদ্ধা তাঁদের অবশ্য প্রাপ্য। তাঁদের প্রতি সেই দেশ, সেই জাতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকবে, এটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এ বিষয়ে আমিও সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু এর সাথে সাথে আর একটা বিষয়ও আমার মনে আসে। সেটা হল, এই পৃথিবী থেকে সমস্ত উপাদান আহরণ করে, হাজার হাজার টনের যে মূর্তিগুলো এই পৃথিবী বুকের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে তো ধারণ করেই রাখে এই পৃথিবী, তার সমস্ত আকর্ষণটুকু নিয়েই। ঐ সুবিশাল মূর্তি দেখতে যখন অজস্র মানুষ দেশ বিদেশ থেকে আসে এবং আবেগে, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় উদ্বেলিত হয়, তখন এক মুহূর্তের জন্যেও কারোর কি মনে হয়, এই পৃথিবী- মা তার সমস্ত ধারণ ক্ষমতাটুকু দিয়ে এই ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকেন বলেই তো অনেক অনেক দিন ধরে এই পৃথিবীর বুকে এই সমস্ত সৃষ্টি দাঁড়িয়ে থাকে মাথা তুলে আর অভিনন্দিত হয় মানুষের কাছে। প্রশংসা পায় সেই মূর্তির স্রষ্টা। শ্বেত-ফলকে খোদাই হয়ে থাকে তার নাম। অথচ এত কিছু দু’হাত ভরে পাওয়ার সময় কখনো কারোর মনে এই কথাটা আসে না যে এই পৃথিবী যদি অতি যত্নে, অতি আদরে ওই সুবিশাল সব সৌধগুলিকে মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য না করত, যদি সে বিদ্রোহ করত, যদি সে চিৎকার করে বলতো- লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এত অসীম গুরুভার বহন করে আমি ক্লান্ত, অপরিসীম ক্লান্ত- তাই আমি আর এই হাজার হাজার টনের অতিরিক্ত গুরুভার বহন করতে পারবো না- তাহলে কি হতো? তাহলেও কি আমরা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার চরিতার্থ করার জন্য একই কাজ করতাম? বোধহয় করতাম, কারণ মানুষ অর্থাৎ আমরা যে নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বুঝিনা সেটা তো প্রতিনিয়তই আমরা বুঝিয়ে দিই। মানুষ ছাড়া আর অন্য কোন প্রাণীরও যে এই পৃথিবীতে মানুষের মতোই বেঁচে থাকার অধিকার আছে, একথা তো আমাদের মনেই থাকেনা। আমাদের প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে অথবা নিছকই খুশির আমোদে প্রাণীহত্যা তো অতি জলভাত ব্যাপার এই মানুষ নামক অতি সুসভ্য, সংবেদনশীল প্রাণীর কাছে। অতএব, অন্য কোন প্রাণীকে জীবিত বা মৃত যে কোন অবস্থাতেই নিজেদের প্রয়োজনে অথবা খেলাচ্ছলে ব্যবহার করে, তারা যে এই পৃথিবীকে ইট,কাঠ,পাথরের মতো নিছকই পদার্থের বেশি কিছু মনে করে না, তা তো বলাই বাহুল্য। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী বলতে কি বোঝায়, সেটা আমরা কতজন ঠিক ভাবে বুঝি! কি জানি আমরা, কতটুকু জানি পৃথিবী সম্পর্কে বা কি ভাবি পৃথিবী সম্পর্কে! আসলে, পৃথিবীটা কি, সেটা খায় না মাথায় দেয়, সেই একেবারেই প্রাথমিক জ্ঞানটুকু অর্জন করা আমাদের পক্ষে এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এই পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে যত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে, মানুষের তৈরি যত বিস্ময়কর সৃষ্টি রয়েছে, সবকিছুই আমরা যেমন প্রাণভরে উপভোগ করব, ঠিক তেমনিভাবেই দিনান্তে একবারও যদি স্মরণ করি এই পৃথিবীকে, যদি মনে মনে বলি, আমরা বড় কৃতজ্ঞ তোমার কাছে, কারণ এই পৃথিবীতে আসার সুযোগ পেয়েছি বলেই এত এত সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে দেখতে পাচ্ছি, যে নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ, ভালোবাসা অর্জন করেছি, তাও এই পৃথিবীর বুক থেকেই। তাই তুমি আমাদের সবার মা। আমাদের সবার প্রণাম তুমি গ্রহণ করো পৃথিবী-মা। শুধু এটুকু পারলেই এই পৃথিবী, যে শুধুমাত্র স্বার্থহীন ভালোবাসায় বিশ্বাসী, আমাদের এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আপ্লুত সেই পৃথিবী- মা হয়তো এক ফোঁটা চোখের জল ফেলবে! যে চোখের জলে ধুয়ে যাবে তাকে অবহেলা করার পাপ, আমরা হয়ে উঠব সত্যিকারের পৃথিবী- মায়ের সন্তান।