।। ষষ্ঠ ৷৷

পাহাড়, নদী, সমুদ্র ও ভয়াল অরণ্য ! উর্বর মরুভূমি অথবা শস্য-শ্যামলা ভূপৃষ্ঠ। সব মিলিয়ে এই প্রকৃতি। পৃথিবীর নিজের হাতে গড়া শিল্পসম্ভার। না, আর একটু যোগ করা দরকার। জীবন্ত শিল্পসম্ভার। যে শিল্পসম্ভার প্রাণবন্ত ও সর্বদাই বেগবান। পৃথিবীর যে প্রান্তে দাঁড়িয়ে যেদিকেই তাকানো যাক না কেন, চোখে পড়বেই, পৃথিবীর নিজের হাতে গড়া, পরম আদরের এই প্রাকৃতিক শিল্পের সুষমা! 
আগের অধ্যায়ে আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ধর্মীয় স্থান। এবারে আমরা আলোচনা করবো বিশ্বের কয়েকটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিস্ময়কর স্থানের কথা। যেখানে ভাবনাও প্রকৃতির নিজের আর সৃজন ও রূপায়নের কৃতিত্ব তারই। তেমনি একটি স্থান হল কলম্বিয়ার ‘রিও ক্রিস্টালেস’ নদী। ভালোবেসে এই নদীকে কেউ বলেন ‘পঞ্চরঙের নদী’। আবার কেউ বলেন ‘তরল রামধনু’। ম্যাকারেনিয়াক্ল্যাভেজেরা নামে ছোট্ট ছোট্ট গুল্ম গোটা নদীর তলদেশকে অতি সুন্দর জীবন্ত লাল রঙে ভরিয়ে দেয়। হলুদ রঙের বালি, নীল, সবুজ শ্যাওলা আর তার ফাঁকে ফাঁকে জীবন্ত লাল রঙের গুল্মের অপরূপ সুষমায় ভরে ওঠে এই নদী। বছরের অন্যান্য সময় এই নদীর রূপ সাধারণ থাকে কিন্তু জুন থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে ভরে ওঠে নানা রঙে আর সেজে ওঠে প্রকৃতির নিজের তুলির টানে।
তিয়ানজি মাউন্টেন অফ চায়না। প্রখ্যাত কানাডিয়ান ফিল্ম মেকার জেমস ক্যামেরুন উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তাঁর ‘অবতার’ ছবিতে পাহাড়ের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে তাঁর ছবিতে পৃথিবীর বাইরের  প্রাণীর মুখ ডিজাইন করেছিলেন। এই পর্বতমালার সর্বোচ্চ চূড়াগুলি অতিসুন্দর বেলে পাথরের তৈরি এবং এক একটি চূড়ার উচ্চতা প্রায় চার হাজার ফুটেরও বেশি। এই অতি সৌন্দর্যময় পর্বতমালা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এক গৌরবময় ইতিহাস বহন করছে। পর্বতের খাঁজে খাঁজে এমনভাবেই মাটি সংরক্ষিত হয়, তার ফলে পর্বতের চারপাশ তো বটেই পর্বতচূড়াতেও বন জঙ্গলের সৃষ্টি হয়েছে।
আমেরিকার ‘অ্যারিজোনা অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়ন’ প্রকৃতির আপন খেয়ালে তৈরি এক অসামান্য সৃষ্টি! বেলে পাথরের তৈরি সুউচ্চ দেওয়াল আর ঢেউখেলানো পৃষ্ঠদেশের এই উপত্যাকার সরু পায়ে চলা সংকীর্ণ পথটি তৈরি হয়েছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এর ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নদীর জলধরার অভিঘাতে ।
জায়ান্টস কজ্‌ওয়ে, নর্দান আয়ারল্যান্ডে প্রাকৃতিক ভাবে নির্মিত আর একটি অত্যন্ত সুন্দর স্থান। এই কজ্‌ওয়ের ষড়ভুজাকৃতি কলামগুলি দেখলে মনে হয় যেন মানুষের তৈরি, লক্ষ বছর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে লাভাস্রোতের কারণে তৈরি হয়েছিল এই কজ্‌ওয়ে। এই ষড়ভুজাকৃতির এক একটি কলামের সর্বাধিক উচ্চতা ছত্রিশ ফুট।
আইসল্যান্ডের একটি অতি সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিদর্শন স্কোসাফস।  অতি সুন্দর ছোট্ট একটি গ্রাম স্কোগার, প্রকৃতি যেখানে উজাড় করে দিয়েছে বিপুল সৌন্দর্য, সেখানেই এই স্কোসাফস জলপ্রপাত। জনশ্রুতি আছে, একজন ভাইকিং, তার বিপুল সম্পদ, সিন্দুক এই বিস্ময়কর জলপ্রপাতের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। সেই জনশ্রুতি সত্যি হোক বা নাই হোক, এই তুমুল উচ্ছাসিত জলপ্রপাত তার জলধারার উল্লাসে সূর্যস্নাত দিনে হাজার হাজার বছর ধরে দুটি উষ্ণ প্রস্রবণ পর্বতের নাবাল ভূমিকে অবিরাম ধারায় স্নিগ্ধ, ঋদ্ধ করে তুলেছে। এই প্রস্রবণের সাথে মিশে থাকা খনিজ পদার্থ ঐ নাবালভূমিতে মিশে গিয়ে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় এক আগুন রঙা রূপ ধারণ করে। এই অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় স্থানটি ইরানে। এর  নামটি বাদাব-এ-সারত।
আর একটি বিখ্যাত প্রাকৃতিক  সৌন্দর্যে ভরপুর স্থানের কথা এইবারে আমরা আলোচনা করবো। সেটি হল সাউথ ইস্ট এশিয়ায় অবস্থিত ইয়েমেনের সকোটরা আইল্যান্ড।এই আইল্যান্ডে এমন কিছু উদ্ভিদ পাওয়া যায় যা সারা বিশ্বে আর কোথাও পাওয়া যায় না। এরমধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল যে গাছটি, সেটি হল ড্রাগন ব্লাড ট্রি। এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য এই গাছের পাতারা একত্রিত হয়ে যে চাঁদোয়ার সৃষ্টি করে, তা দেখতে ফ্লায়িং সসারের মত লাগে।
প্রকৃতি আপন খেয়ালে বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি করে একের পর এক বিস্ময়কর বস্তু। তেমনি এক সৃষ্টি হল, নিউজিল্যান্ডের ওয়েটোমো গ্লোওয়ার্ম কেভস। হাজার হাজার গ্লো-ওয়ার্ম বা বাংলায় আমরা যাদের বলি জোনাকি পোকা, সেই রকম পোকা তাদের মিলিত আলোয় উজ্জ্বল করে তোলে গুহাগুলিকে। আঠারোশো উননব্বই সাল থেকে এই গুহাগুলি ভ্রমণকারীদের জন্য খুলে দেওয়া হলেও এখানকার প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী মাওরিদের কাছে এই গুহাগুলি অনেক আগে থেকেই পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে মাওরি শব্দ ‘ওয়াই’ যার অর্থ জল আর ‘টোমো’ শব্দের অর্থ হলো গর্ত বা প্রবেশপথ। পর্যটকদের উৎসাহ, আনন্দ ও উত্তেজনা চরম শিখরে পৌঁছায় যখন তারা নিঃশব্দে গণ্ডোলায় চড়ে ওই গুহার মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করেন।
প্রকৃতির আর এক আশ্চর্য দান অস্ট্রেলিয়ার বাব্‌ল গাম পিঙ্ক লেক। বিজ্ঞানের সব যুক্তি নিয়মের বিরুদ্ধে যেন এক মুখ গোলাপি হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই লেক। বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় এক ধরনের সামুদ্রিক ছত্রাক এই লেকে পরিব্যপ্ত এবং তার লবণাক্ত ভাব যখন অত্যন্ত বেশি হয়ে যায় তখনই আরো গাঢ় হয়ে ওঠে এই রং আর অন্য মতটি হলো এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া যার নাম ‘হ্যালোব্যাকটেরিয়া’ যা এই লেকে একেবারে ছেয়ে আছে। রিচার্চে আর্চিপেলাগোর মিডল আইল্যান্ডে অবস্থিত 
এই অতি সৌন্দর্যময় দ্বীপটি একমাত্র হেলিকপ্টারে ভ্রমণরত অবস্থাতেই দর্শন করা সম্ভব।
কানাডার ব্রিটিশ-কলম্বিয়া প্রদেশে অবস্থিত স্পটেড লেক প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়ালের সাক্ষী। ওক্‌নাগন আর সিমিকামীন উপত্যাকার মাঝে অবস্থিত এই লেকে কী অসামান্য, অদ্ভুত স্পট রয়েছে। যেন উদাসীন এক বিশ্ব শিশু তার আপন মর্জিতে খেলার ছলে অজস্র আঁকিবুঁকিতে ভরে দিয়েছে লেকের বুক। আসলে এই লেকে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম সালফেট এবং অন্যান্য আরো অনেক ধরনের খনিজ পদার্থ। তাই লেকের এমন অনিন্দ্য সুন্দর রূপ।
থর’স ওয়েল বা থরের কূপ। এই  সিঙ্কহোল সাধারণত প্রাকৃতিক বিভিন্ন বিভিন্ন বিপর্যয়ের ফলে ভূপৃষ্ঠের শেপ বা ফর্মের পরিবর্তনের ফলে তৈরি হয়। গ্রিক পুরাণে ক্যারিডিস নামে এক প্রাণীর উল্লেখ আছে যে নাবিকদের প্রবল স্রোতে ডুবিয়ে মারতো। মনে করা হয় যে সমুদ্রের তলায় অবস্থিত গুহার ছাদ একসময় ভেঙে পড়ে এই গুহার উৎপত্তি ও প্রকাশ হয় এবং এতই বিশাল ও বিপুল ঐ গুহা যে সমুদ্র প্রবল বেগে সগর্জনে ওই গুহার ভেতরে আত্মনিবেদন করেছিল।
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে ‘রেডউড ন্যাশনাল পার্ক’ এই আশ্চর্য রহস্যময়ী পৃথিবীর আর এক আশ্চর্য অবদান। এক লক্ষ উনচল্লিশ হাজার একরের এই রেডউড ন্যাশনাল পার্ক ক্যালিফোর্নিয়ার সমগ্র উত্তর উপকূল জুড়ে বিরাজ করছে। এই পার্কের পরম বৈশিষ্ট্য হলো রেডউড ট্রি। পৃথিবীর উচ্চতম গাছগুলির অন্যতম। তিনশো উনআশি ফুট উচ্চতার একটি গাছের বয়স কমপক্ষে ছ’শো বছর।
তুর্কির পামুকেল শহরে রয়েছে আর এক আশ্চর্য প্রাকৃতিক সৃষ্টি। আদর করে এই সৃষ্টিকে তুলোর প্রাসাদ বলে ডাকা হয়। প্রাকৃতিক উষ্ণপ্রস্রবণ থেকে উৎসারিত জল প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হওয়া বিশাল বিশাল জলাধারে সংরক্ষিত হচ্ছে। এই জলাধারগুলিও অতি আশ্চর্যজনকভাবে এমন আড়াআড়িভাবে রয়েছে যা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা। নানা খনিজ পদার্থে পরিপূর্ণ এই উষ্ণ জল অনবরত হয়ে চলেছে এই জল গুলির মধ্যে দিয়ে। সূর্যের আলো ধবধবে সাদা রঙে সমৃদ্ধ করে তুলে প্রকৃতির এই ভালোবাসার সৃষ্টিকে। আসলে প্রকৃতি তার অফুরন্ত ভালোবাসা আর অফুরন্ত ক্ষমতা নিয়ে এই পৃথিবীর নানা স্থানে অতি বিস্ময়কর কোনো সৃষ্টির স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে নানা সময়ে। এই ‘প্যালেস অফ কটন’ও ঠিক সেই রকমই এক সৃষ্টি।
ফুজিয়ামা আগ্নেয়গিরি। জাপানের জীবন্ত আগ্নেয়গিরি এই ফুজিয়ামা আগ্নেয়গিরি। সতেরশো সাত সালে শেষবারের মতো এই আগ্নেয়গিরির উদ্‌গীরণ হয়। মাউন্ট ফুজিয়ামাই জাপানের উচ্চতম পর্বত। এই পর্বতের উচ্চতা বারো হাজার তিনশো পঁয়ষট্টি ফুট এবং অধিকাংশ সময়ই এই পর্বত কুয়াশার ঘন আস্তরণে ঢাকা থাকে। যদিও অনেক অনেক বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে এই আগ্নেয়গিরি, কিন্তু সিংহ এই মুহূর্তে ঘুমিয়ে আছে বলে পরমুহুর্তেই এক ঝলক বিদ্যুতের মতো শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না তা কে বলতে পারে! Freak of Nature কি রূপে আবির্ভূত হবে আমাদের সামনে, সেই সিদ্ধান্তও তো তারই। যার বুকে এই অপার সৌন্দর্যময় স্থানেরা তার একান্ত প্রিয় ও আজ্ঞাবহ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আজারবাইজানের রাজধানী বাকু শহরের অল্প কিছু দূরে এই মাসাজির লোকের অবস্থান। এই গোলাপী বর্ণের লবণ হ্রদটি গ্রীষ্মকালে তার পূর্ণ রূপটি প্রকাশ করে। হ্যালোফাইল নামে ব্যাক্‌টেরিয়া বা জীবাণুর সাহায্যে এই লবণ হ্রদের অনুপম রূপটি ফুটে ওঠে।
এইবারে প্রকৃতির শিল্প ভান্ডারের যে অসামান্য আপন সৃষ্টির দ্বার আমাদের এই আলোচনায় উন্মুক্ত করার চেষ্টা করব আমরা তা হল- দি ডেড সি, ইজরায়েল এন্ড জর্ডন। জর্ডনের পূর্ব দিকে এবং ইজরায়েল ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের পশ্চিম দিকের সীমান্ত ছুঁয়ে আছে এই ডেড সি বা মৃত সাগর। জর্ডনের লিফ্‌ট ভ্যালিতে অবস্থিত এই এশিয়ার লবণ হ্রদের তলদেশ এবং তীরভূমি চারশো তিরিশ দশমিক পাঁচ মিটার গভীর এবং পৃথিবীর সর্বনিম্ন তলদেশ। এই ডেড সি বা মৃত সাগর নামকরণ হয়েছে এই কারণেই যে এখানে কোন মাছ নেই এবং জীবনের কোন চিহ্ন নেই। কারণ এই জল অত্যন্ত ঘন এবং অতি লবণাক্ত। প্রকৃতির বড় অদ্ভুত খেয়ালে সৃষ্টি এই মৃত সাগর। যে প্রকৃতিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে, সেখানে বিরাট এক মৌণ সন্ন্যাসীর মত কেন এই সাগর! কিসের ধ্যানমগ্ন সে! কোনো পাপে, কোনো অন্যায়ের কারনে সে কি অভিশাপগ্রস্ত! অনেক ভাবনার পর আমার মনে হয়েছে, আসলে তা নয়; পৃথিবীর পরমপ্রিয় এই অনুচর আসলে আমাদের প্রতি এই পৃথিবীর এক সংকেতময় ইঙ্গিত ! পৃথিবী নিজের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে এ বিশ্বের সর্বত্র যে সৌন্দর্যের পশরা সাজিয়েছেন আমাদের জন্য, তার বিনিময়ে সে আমাদের কাছে না আদায় করেছে কোন ট্যাক্স, না নিয়েছে কোন দর্শন মূল্য। ধ্যান গম্ভীর পর্বত, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, ফুলের হাসি মুখ বা মৃত সাগরের কঠিন স্তব্ধতা- এই সবের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী তার যে বার্তা আমাদের কাছে পৌঁছে দেয় তা হল ধৈর্যশীল হও পর্বতের মতো, উজ্জ্বল, অবারিত হও সমুদ্রের মতো, ফুলের মত সুন্দর হোক আমাদের ব্যক্তিত্ব ও ব্যবহার এবং মৌন মৃত সাগরের মত শ্রদ্ধাবনত নতজানু হতে পারি পৃথিবীর অপার মহিমার প্রতি, তার আশ্চর্যতম সৃষ্টির প্রতি।
ঝ্যাংগিদানেক্সিয়া ল্যান্ডফর্ম জিওলজিক্যাল পার্ক, গানাসু, চায়না। পৃথিবীর এক অতি আশ্চর্য নিসর্গ দৃশ্য এই দানেক্সিয়া। দক্ষিণ-পশ্চিম চায়নায় অবস্থিত এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যটি হলো অজস্র রঙিন আলপনার আলিঙ্গন শরীরে অক্লেশে গ্রহণ করে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা এই পর্বত। আসলে অজস্র খনিজ পদার্থ এবং রঙিন পাথর মিলে সৃষ্টি করেছে এই মায়াবী রূপকথা! একসময়ে স্বল্প পরিচিত এই স্থানটি ইউনেস্কোর বিশ্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য সম্পন্ন দ্রষ্টব্য স্থানের তালিকায় স্থান পেয়েছে আর অজস্রপর্যটক আজ এখানে ভিড় করেন তাই দেখতে যা তারা এর আগে কোনদিন দেখেননি বা দেখবেন না পরেও কোনো দিন।
এই কথাগুলো লিখতে লিখতে এক এক সময় আমার মনটা বড় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আপনাদের সঙ্গে আমার কথাগুলো ভাগ করে নিতে নিতে অস্থির একটা ভাব যেন ক্রমাগত ঘরের বাইরের দিকে ঠেলতে থাকে আমাকে। কলম ফেলে ছুটে যায় আমার সেই বন্ধুদের দিকে যাদের সঙ্গে এই বই লেখার একেবারে শুরুতেই আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম! আসলে এই লেখার মধ্যে দিয়ে আমি একা আপনাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছি, এটাই হয়তো আপনারা ভাবছেন! কিন্তু তা নয়, একেবারে নয়। আমরা সবাই মিলেই চেষ্টা করছি সংযোগ স্থাপনের। সব যোগাযোগের জন্যেই যে ভাষা আবশ্যিক তা নয় ! ভাষা আবিষ্কারের আগে কি মানুষ মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করত না! পশু-পাখিরা কি তাদের মতো করে যোগাযোগ করে না! আমার বাগান-সভার বন্ধুদের সঙ্গে আমার যে সুমধুর মানসিক যোগাযোগ, আমি কথা দিচ্ছি, এই বইয়ের শেষ পাতার শেষ শব্দটি যখন আপনার করে ফেলবেন, তখন নিজেরাই অনুভব করবেন আমাদের সবার সঙ্গে ইথার তরঙ্গে ভর করে, টেলিপ্যাথিক কানেকশনের মাধ্যমে আমাদের সবার সাথে কেমন আত্মার যোগাযোগ ঘটে গেছে আপনাদের! আর সবাই তো এটা জানি আত্মা অখন্ড, অবিনশ্ব্‌র, এক পরম শক্তি আর সর্বভূতে বিরাজমান! আর সেই সর্বভূত অর্থাৎ সর্বজীবের মধ্যে মানুষও যেমন আছে, প্রাণ-সম্পন্ন গাছও যে আছে তা তো প্রমাণিত, পরীক্ষিত সত্য! যাইহোক যা বলছিলাম, ছুটে গিয়ে আমার বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে- তোমরা কি জানো সেই শিল্পীর নাম আর ঠিকানা যে এমন সুন্দর সব সৃষ্টি করেছে! উৎকর্ষতার কোনো সীমায় এই সৃষ্টিকে বাঁধা যায় না, বরং এই সৃষ্টিই নির্ধারণ করে উৎকর্ষতার মাপকাঠি,আর এই উৎকর্ষতাকে ছাপিয়ে যাওয়া একমাত্র সেই শিল্পীর পক্ষেই! উত্তরটা তাদের মতো যদিও আমারও জানা, এই শিল্পীর নাম প্রকৃতি আর তার স্রষ্টার নাম পৃথিবী।
কেনিয়ার  নাকুর লেক একটি ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত। এই ন্যাশনাল পার্কটি এক মহাকাব্যিক রূপ ও সুষমায় ভরে ওঠে তার কিছু অনন্যসাধারণ সম্পদের জন্যে, যার শ্রেষ্ঠতম সম্পদ হলো উজ্জ্বল গাঢ় গোলাপী রঙের ফ্লেমিংগো পাখি। বৃহৎ নাকুর লেকের চারপাশে রয়েছে জলাভূমি, জলাভূমি ও তৃণভূমি। এই জলাভূমি ও তৃণভূমিতে রয়েছে গন্ডার, হিপোপটেমাস, ওয়াটারবাক্‌ নামে এক ধরনের হরিণ এবং জলহস্তী। এখানে প্রকৃতির কোলে প্রকৃতির সন্তানদের নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে বাস করার ব্যবস্থাও প্রকৃতি স্বয়ং করেছেন।
ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার উটাহ প্রদেশে অবস্থিত এই গবলিন  ভ্যালি। প্রথম কাউবয়রা আবিষ্কার করে তাদের হারানো গবাদি পশু খুঁজতে গিয়ে। গবলিন অর্থাৎ রূপকথায় উল্লেখিত কুৎসিত দর্শন বামনাকৃতি লোকের সঙ্গে এখানকার পাহাড়ের দৃশ্য দেখে এই উপত্যকাকে গবলিন ভ্যালি বলা হয়। তীব্র বাতাস ও প্রবল জলোচ্ছাসের ফলে ধীরে ধীরে ভুমিস্তর ক্ষয়ে গিয়ে এই উপত্যাকার জন্ম হয়। এও প্রকৃতির এক আশ্চর্য লীলা। নিজের সম্পদকে, পৃথিবীর নিজস্ব প্রাকৃতিক উপাদান কে কাজে লাগিয়েই যুগ যুগ ধরে গড়ে তুলেছে অবিস্মরনীয় সব সৃষ্টি।
এইসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা স্থানগুলিতে ভ্রমণ করতে করতে বারবার আমার পাঠকদের সাথে আমারও একটা কথাই মনে হয়েছে; সেটা হলো খেলার ছলে, নিজের খেয়ালে প্রকৃতি যে অনুপম সৌন্দর্য অতি অনায়াসে সৃষ্টি করেছেন, আমাদের সমস্ত দক্ষতা ও সিরিয়াসনেসকে কাজে লাগিয়েও তার একাংশ সৌন্দর্যও কি আমরা সৃষ্টি করতে পারব! উত্তর- না, না এবং না।
            রাতের বেলায় এক
                 আলোর মেলা
             সমুদ্র আকাশ জুড়ে
                 খুশির ভেলা
             যেখানে পৃথিবী খেলে
                 আনন্দে নিজের মতো
            এমন আশ্চর্য রং
                দ্বীপে দ্বীপে ছড়ানো কত
             রামধনু লুটোপুটি খেয়ে
                 পৃথিবীর পায়ে ধরে এসে
             আকাশ সমুদ্র মিলেমিশে 
                পৃথিবীর গান ধরে হেসে
মালদ্বীপেরএক হাজার একশো নব্বইটি দ্বীপের যেকোনো একটায় প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা এই মায়াবী খেলা দেখতে পাওয়া যায়। প্রকৃতি এখানে প্রতিরাতে পৃথিবীকে খুশি করার খেলায় মাতে। পৃথিবী স্বয়ং এখানে প্রকৃতির খেলার দোসর, তার খেলার একমাত্র সাক্ষী। কে দেখল, কে দেখল না, এই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই তাদের। এ তাদের খেলা, তাদের চিরদিনের চিরনতুন খেলা। বিজ্ঞানএই খেলার নানা রকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছে নানা সময়। কোনো সময় বলেছে ছোট ছোট সামুদ্রিক উদ্ভিদ সমুদ্রের ধারে একসঙ্গে হয়ে অথবা ছোট ছোট উজ্জ্বল সামুদ্রিক মাছের কারণে কিংবা অনেক অজস্র আলোক পোকার সমাহারে ঘটে এই বিস্ময়কর মায়াবী আলোর খেলা! ‘বিজ্ঞান’ এই কথাটিকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয় বিশেষ জ্ঞান। এই ব্যাখ্যা হয়তো সর্বৈব সত্য, শুধু আমার বিনীত নিবেদন, এই বিশেষ জ্ঞানের দ্বারা কোনদিন কি একথা জানা যাবে যে, কেন, কি উদ্দেশ্যে এবং কার নির্দেশে, না, অ-পার্থিব নয়, অতিমাত্রায় পার্থিব এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে এবং হচ্ছে! এই পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে এই পৃথিবীর বদান্যতায় আশ্চর্যতম সব দৃশ্য দেখি, তা সে আকাশে হোক বা সমুদ্রে, জঙ্গলে হোক অথবা পাহাড়ে- কিন্তু বলার সময় অ-পার্থিব দৃশ্য বলে বর্ণনা করি; কেন তা হবে! কেন সেই দৃশ্য অথবা দৃশ্যগুলোকে আমরা পরম পার্থিব দৃশ্য বলে শ্রদ্ধায় মাথা নত করবো না! আমাদের বর্ণনার অক্ষমতা অথবা ভাষার দীনতা তো আমাদেরই। আর এখানেই পৃথিবী-মা অনন্য আর মহোত্তম। তার সৌন্দর্য সৃষ্টিতে আমরা আপ্লুত হলাম কিনা অথবা কিভাবে তার বর্ণনা দিলাম বরং তুলিতে সেই সৌন্দর্যকে আদৌ ধরতে পারলাম কিনা, তা নিয়ে পরম নির্বিকার আর উদাসীন এই পৃথিবী। নিজের বিশালতম ক্যানভাসে দিন-রাতের প্রতিটি মুহূর্তকে জীবন্ত করে তুলছে বিরামহীনভাবে। তাই সে আর তার সৃষ্টিই মহত্তম।
চিলির মার্বেল কেভ্স। পাটাগোনিয়ার জেনারেল কারেরা লেক এ অবস্থিত এই মার্বেল কেভ্সকে মার্বেল ক্যাথিড্রাল নামেও ডাকা হয়। এই মার্বেল কেভ্স তৈরি হয়েছিল প্রায় ছয় হাজার বছর আগে। প্রবল জলের ঢেউয়ে পাথর ক্ষয়ে গিয়ে তৈরি হয়েছিল এই গুহাগুলি। অপূর্ব সৌন্দর্যময় এই গুহাগুলির সৌন্দর্য দিনের বিভিন্ন সময়ে পাল্টে পাল্টে যায়, আর সেই পাল্টে যাওয়ার কারণ জলের গভীরতা, তীব্রতা এবং আকাশ-নীল রঙের জল যখন এই মার্বেলে আছড়ে পড়ে, তখনই অসামান্য সব রঙের বিচ্ছুরণ ঘটে! আগাগোড়া মার্বেলে মোড়া ওই গুহাগুলি যখন হরেক রঙের বর্ণময় ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তখন সত্যি সত্যিই রঙিন মার্বেল প্রাসাদ বলেই মনে হয়।
এই মার্বেল কেভ্স বা মার্বেল ক্যাথিড্রাল, এই শব্দগুলো লিখতে আর একটা কথাও মনে পড়ছে, আর সেটা লিখতেও খুব ইচ্ছে করছে যে- হু ক্রিয়েটস হিস্ট্রি, হ্যাজ নো টাইম টু রাইট ইট। এই কথাটি এই কারণেই উল্লেখ করলাম যে এই রঙিন মার্বেলের গুহা-প্রাসাদ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম। এই সৌন্দর্য সৃষ্টির পর তার নামকরণ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা এই পৃথিবীর ছিল না, কারণ অতি অবলীলায়, খেলাচ্ছলে অত্যাশ্চর্য সব সৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা পৃথিবী একের পর এক সৃষ্টি করে গেছে। শ্রেষ্ঠতম ইতিহাস সৃষ্টিকর্ত্রী পৃথিবীর তাগিদ নেই তার সৃষ্টির নামকরণের, না কোন সৃষ্টিগাথা লেখার বা না সৃষ্টির কোনো ইতিহাস লেখার। পৃথিবীর কিছু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা স্থানের কথা এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি। এই বিশাল পৃথিবীতে অনন্ত রহস্য আর অপার বিস্ময় লুকিয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ বড়ো বিস্ময়ে বলে উঠেছিলেন- বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার প্রাণ। এই বিষয়ে শুধু তাঁর একার নয়, এ বিস্ময় আবহমান কাল ধরে বয়ে চলা এই মানব সভ্যতার। এই পৃথিবী কিভাবে তৈরি হলো! এই নিয়ে চলছে প্রচুর গবেষণা, তা থেকে উঠে আসছে প্রচুর নতুন নতুন তথ্য, যে তথ্য কোন সময় আগের কোন সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানাচ্ছে, আবার কখনো বা পুরনো সিদ্ধান্তকে নস্যাৎ করে দিয়ে নতুন এক তথ্য উঠে আসছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। অনেক অনেক দিন ধরেই বৈজ্ঞানিকরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এই পৃথিবীর জন্ম কিভাবে হল তা জানার জন্য। বলাবাহুল্য, একেবারে সঠিকভাবে সব তথ্য যে জানা হয়ে গিয়েছে, এমনটা নয়, তবে এ বিষয়ে অনেক তথ্যই আজ আমাদের জানা।
কয়েক হাজার বছর আগে যখন মিশরীয় সভ্যতা উন্নতির চরম শিখরে এবং গোটা বিশ্বের বিস্ময়, তখন মিশরের পুরোহিতরা, যারা তখন পৃথিবীর সব থেকে জ্ঞানী মানুষ বলে অভিহিত হতেন, তারা রোজ দিন-রাতের বিষয়টিকে খুব অদ্ভুত একটা ব্যাখ্যায় উপস্থাপিত করেছিলেন। যদিও আজকের দিনে সেই ব্যাখ্যা আমাদের কাছে খুব মজাদার মনে হয়! সেই সময় বলা হত স্বর্গের রাজহাঁস রোজ খুব ভোরে আকাশের গায়ে একটা করে সোনার ডিম পাড়ে আর সেই সোনার ডিম ফুটে যে বাচ্চা বেরোয় সেই বাচ্চাটাই হল সূর্য! সোনার সূর্য। সারাদিন সেই সোনার বাচ্চা একটু একটু করে বড় হয়ে, আকাশের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছুটোছুটি করে খেলা করে বেড়ায় আর রাত্রি হলেই শেষ হয়ে যায় তার এই একদিনের সোনার জীবন! মরে যায় সেই বাচ্চা! তারপরের দিন আবার সেই রাজহাঁসের সোনার ডিম পাড়া আর সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আজকের দিনে যদিও এই মতবাদ নিতান্তই রূপকথার গল্পের মতো শোনায়, কারন আমরা সবাই জানি যে সূর্য অতিবৃহৎ এক আগুনের গোলা আর তা এতই প্রকাণ্ড যে আমাদের এই পৃথিবীর মতো আরো অনেক অনেক পৃথিবী ঐ সূর্যের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। এই পৃথিবীর উৎপত্তি ঐ সূর্যের থেকেই আর ঐ ভয়ঙ্কর উত্তপ্ত অগ্নিপিন্ড থেকে জন্মাবার ফলেই পৃথিবী একেবারে আদিতে ভয়ঙ্কর ভাবে উত্তপ্ত ছিল। ক্রমশঃ একটা গ্যাসীয় অবস্থা থেকে পৃথিবী একটা তরল অবস্থায় পরিণত হল। অতি তীব্র ভূমিকম্পে ওলট-পালট হয়ে গেল পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ। কোথাও সৃষ্টি হলো উঁচুউঁচু পাহাড়। কোথাও আবার সমুদ্রের ভয়ংকর স্রোত প্লাবিত করেছিল কোটি কোটি বর্গ-মাইল এলাকা! ধীরে ধীরে পৃথিবী হলো শান্ত। এলো প্রাণের স্পন্দন। অতিক্ষুদ্র ছত্রাক থেকে এককোষী প্রাণী হয়ে প্রকাণ্ড প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী আর তারও অনেক পরে এল আমাদের অর্থাৎ মানুষ নামক প্রাণীর আদিরূপ। এগিয়ে চলে বিবর্তনের ইতিহাস তার আপন অমোঘ গতিতে। রূপান্তর ঘটতে লাগলো পৃথিবীর। ক্রমশঃ আদি মানব, বনমানুষের স্তর পেরিয়ে আজকের মানুষের স্তরে এসে পৌঁছলাম আমরা। ভূপৃষ্ঠের গভীর স্তরে অতি তাপসম্পন্ন গ্যাসীয় বা তরল অবস্থা থাকলেও পৃথিবীর উপরের তলের অবস্থা কিন্তু প্রাণীর বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠলো। শস্যশ্যামলা হয়ে উঠল এই পৃথিবী। এইখানেই মহত্তম আমাদের এই পৃথিবী। বুকের ভেতরের অসহ্য জ্বালা আর উত্তাপে প্রতি মুহূর্তেই পৃথিবীকে যন্ত্রনা পেতে হচ্ছে চরমভাবে কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ তো আমাদের প্রতি তার আচরণে আমরা দেখতে পাই না! আমি জানি, এর উত্তরে অনেকেই সঙ্গে সঙ্গে বলবেন যে কেন? চারপাশে আমরা তো অহরহই দেখতে পাই নানান ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। হ্যাঁ, একথা ঠিক কিন্তু আমি এই কথাটা অত্যন্ত বিনীতভাবে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি যে, যত প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে, প্রাণী-সম্পদ নষ্ট হয়, প্রাণহানি ঘটে- তার অধিকাংশের জন্যেই আমরা, অত্যাধুনিক মানুষ বলে বড়াই করা এই সব থেকে বুদ্ধিমান প্রাণীরাই কি দায়ী নই? এই পৃথিবী যা কিছু সম্পদ ও সৌন্দর্য আমাদের জন্য রেখে দিয়েছে, তার শতকরা একশোভাগ ভোগ ও উপভোগের ইজারা তো আমরা জন্মসূত্রেই যেন পেয়ে গেছি। কারণ জন্মাবার পর একটু জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমরা পৃথিবী থেকে শুধু নিয়েই যাই; আসলে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক ভালো ভালো গুণ হয়তো অর্জন করি, কিন্তু যে শিক্ষা আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করা উচিত ছিল, তা হল সবার আগে এই পৃথিবীকে ভালোবাসার আর তাকে যত্ন করার শিক্ষাই পাওয়া উচিত ছিল। আমরা রক্তের সম্পর্কে আত্মীয়তাকে সগর্বে মেনে নিয়ে তাকে আজীবন বহন করে চলি, গর্বিত হই সেই পরিচয় প্রকাশ করতে এবং সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েও আমরা আত্মীয় হয়ে উঠি পরস্পরের, কিন্তু যে আমাদের পরম আত্মীয়, যে আমাদের সবথেকে কাছের আত্মীয় সেই পৃথিবীর কথা আমাদের খেয়ালই থাকে না, তাকে আত্মীয় বলে ভাবা তো অনেক দূরের কথা। অথচ এই পৃথিবী জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের আগলে রেখে দেয়। কোন গুরুতর কারণে মা সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারে, কিন্তু কোনদিন কেউ কি শুনেছে, পৃথিবী কোন মানুষকে ত্যাগ করেছে! সন্তানকে বাবা-মা ত্যাজ্য করতে পারে, কোন মানুষকে গৃহচ্যুত, পরিবারচ্যুত, সমাজচ্যু্ত এমনকি দেশচ্যুতও হয়তো করা যেতে পারে, কিন্তু কেউ কাউকে জোর করে পৃথিবীচ্যুত করতে পেরেছে কি কোনদিন? এমনকি তাকে হত্যা করা হলেও তো এই পৃথিবীর বুকে তার শেষ আশ্রয় পায় সে! ঠিক তেমনি ভাবেই বাবা-মায়ের ত্যাজ্য সন্তান কিন্তু পৃথিবীর ত্যাজ্য সন্তান হয় না কোনদিন! এই বিশাল ভূ-খন্ডের কোথাও না কোথাও সে ঠিকই আশ্রয় পায়। এরপরেও কি আমরা পৃথিবীকে আমাদের আত্মীয় বলে মেনে নেব না! তার থেকে বড় আত্মীয় আর কে হতে পারে আমাদের! ছোটবেলা থেকে আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়, অতি সামান্য উপকার কেউ যদি করে তাহলে মাথা নীচু করে সেই উপকারের কথা স্বীকার করতে হয়। সুযোগ পেলে সেই উপকারীর পাশে দাঁড়াতে হয়। কিন্তু পুরুষানুক্রমে কখনোই এ শিক্ষা আমাদের দেওয়া হয় না, যে পৃথিবীর বুকের ওপর দাঁড়িয়ে এই শিক্ষা আমরা দিই এবং পাই, যে পৃথিবীতে আমরা যাবতীয় সম্পর্ক ও আত্মীয়তা গড়ে তুলি, যেখানে আমরা আমাদের নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ, প্রেম, ভালোবাসা- সবকিছু পাই, সেই পৃথিবীর উপকারই আমাদের সবার আগে এবং সব সময় মনে রাখা উচিত। সব শিক্ষার ভিত গড়ে ওঠে আমাদের ঘর থেকে, শুধু পৃথিবীর প্রতি কর্তব্যের কোন শিক্ষাই আমরা পাইনা! প্রাথমিক জ্ঞানের অনেক বই বাজারে পাওয়া যায়। তা থেকে আমরা নিজেরা শিখি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও শেখানোর চেষ্টা করি, কিন্তু এমন একটা বই কি আমরা পেতে পারি না, যে বইয়ের শিরোনাম হবে প্রাথমিক পৃথিবী-জ্ঞানের বই। আহা, কবে আসবে সেই দিনটা, যেদিন চোখের সামনে এরকম একটা ছবির বই দেখতে পাবো, নতুন বইয়ের গন্ধে আমার বুক ভরে যাবে, মনে হবে পৃথিবী-মায়ের গায়ের পবিত্রতম গন্ধ আর বইয়ের পাতায় হাত রাখলে মনে হবে, আমি পবিত্রতম পৃথিবী মায়ের পরম আদরের স্পর্শ পাচ্ছি আমার হাতের আঙুলে, আমার সারা শরীরে। কতদিন, আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে সেই দিনটার জন্য! সেই বইতে থাকবে একেবারে প্রাথমিক জ্ঞানটুকু! আমরা আমাদের বাবা-মাকে যেমন ভালোবাসবো, আমরা আমাদের চারপাশে যত পরিচিত, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে ভালোবাসবো, ঠিক তেমনিই ভালোবাসবো প্রকৃতিকে, গাছপালা, ফুল, পাখি, প্রজাপতিকে। আমরা জানবো পৃথিবী বলতে প্রকৃত অর্থে কি কি বোঝায়, আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এই পৃথিবীর অবদান ঠিক কতখানি! এই প্রাথমিক জ্ঞানটুকু আমরা যদি অর্জন করতে পারি আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে যদি এই জ্ঞানটুকুর আওতায় আনতে পারি, তাহলে দেখা যাবে এই প্রাথমিক পাঠটুকু একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাবে! পরবর্তী প্রজন্ম আবার তার পরের প্রজন্মকে সানন্দে ওই প্রাথমিক জ্ঞানের পাঠ দেবে। এভাবেই একদিন এই বিশেষ প্রাথমিক জ্ঞান ছড়িয়ে পড়বে সবার মধ্যে। পৃথিবী জ্ঞানে জ্ঞানীদের কাছে আর সব বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের পথ সুগম হয়ে যাবে। আমাদের প্রয়োজনে, বিপদে বা প্রতিদিনের অভ্যাসে আমরা ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করি, কিন্তু একথা একবারও মনে আসে না, ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করি যে পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে, যে পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে আমরা নানা ধর্মীয় আচরণ পালন করি, তখন কি আর ভেবে দেখি যে এই ধর্মীয় আচরণ আমরা পালন করতেই পারতাম না যদি এই পৃথিবীর অস্তিত্ব না থাকতো, অথবা এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব না থাকতো! ধর্মীয় রীতিনীতি পালন থেকে শুরু করে এই পৃথিবী জুড়ে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে যে অজস্র আনন্দ, উৎসব, বিপুল ক্রীড়ানুষ্ঠান পালিত হয়েছে বা হচ্ছে, তা একমাত্র পালিত হতে পারছে এই পৃথিবীর বদান্যতায়। যে কোন উৎসব, অনুষ্ঠানে আমরা প্রাণ খুলে নিজের নিজের দেশের জাতীয় সংগীত গাই। তা সে অনুষ্ঠান দেশের মাটিতেই হোক, অথবা বিদেশে। যে বা যারা সেই জাতীয় সংগীত গায়, তারা যেমন উদ্দীপ্ত হয়, তেমনিই উপস্থিত সেই দেশের নাগরিকরাও আবেগে, উত্তেজনায় এক হয়ে মিলেমিশে এক অবর্ণনীয় জাতীয় আবেগে। জাতীয় পতাকা, আর জাতীয়সংগীত-যে কোন স্বাধীন দেশের নাগরিকের কাছে এর চাইতে শ্লাঘার বস্তু আর নেই। এই জাতীয় সংগীত নিয়ে আবেগ আর গর্ব বড়োই পবিত্র! যেকোনো স্বাধীন দেশের পতাকা আর তাদের জাতীয় সংগীতের সাথে মিশে থাকে রক্ত, ঘাম, চোখের জল আর লড়াইয়ের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। অনেক প্রাণের বিনিময়ে উত্তোলিত হয়, এক স্বাধীন দেশে পতাকা আর হাজার কণ্ঠ গেয়ে ওঠে জাতীয় সংগীত। একটা দেশ কতক্ষণ পরাধীন থাকে যতক্ষণ বেশি শক্তিশালী কোন দেশ তার অস্ত্রবলে আর আগ্রাসী লোভের তাড়নায় অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশের শাসন ক্ষমতা গায়ের জোরে দখল করে এবং সেই ভূখণ্ডে নিজেদের শাসনতন্ত্র কায়েম করে সেই দেশকে নিজের অধীন বলে ঘোষণা করে! তারপর, কিভাবে সেই পরাধীন দেশ স্বাধীন হয়, সে কথা তো আগেই আলোচনা করলাম! কিন্তু এই বিপুল পৃথিবীর কিছু অংশ বা ভূখণ্ডকে সত্যি সত্যি পরাধীন করা যায়! স্বয়ম্ভূ এই পৃথিবী সব অর্থেই স্বাধীন। নিজের গতিতে,সহজ ছন্দেবয়ে চলা নদী- যাকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘নদী আপন বেগে পাগলপারা,’ অটল গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়, গভীর রহস্যময় অতি ঘন জঙ্গল, হাজার হাজার পরিযায়ী পাখির পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত উড়ে যাওয়া, একটা প্রজাপতির খুশির ওড়াউড়ি কিংবা একটা ছোট্ট কুঁড়ির নিজের ইচ্ছেয় ফুল হয়ে ফুটে ওঠা- এই প্রত্যেকটা বিষয় কি এই একই কথাই ঘোষণা করে না যে এই পৃথিবী একমাত্র নিজের অধীন, অন্য কারোর নয়! স্ব-অধীন বা স্বাধীন একমাত্র এই পৃথিবীই। সেই পৃথিবীর কোন ভূখণ্ড, কোনো কাঁটাতারের বেড়া বা পাঁচিলের বাধায় কখনো পরাধীন হতে পারে না। আচ্ছা, এমনটা তো হতেই পারে, একদিন পৃথিবীর যে প্রান্তে যে ধরনের অনুষ্ঠান হোক না কেন আর তা যত ছোট বা বড়ই হোক না কেন, সেখানে কোন দেশের সংগীত নয়, কোন জাতীয় সংগীত নয়, গাওয়া হবে পৃথিবী-সংগীত বা ওয়ার্ল্ড অ্যান্থেম। সবাই মিলে প্রাণ খুলে মাথা উঁচু করে, গলার শিরা ফুলিয়ে গাইবে সেই গান! হ্যাঁ, জাতিধর্ম-বর্ণ-দেশ নির্বিশেষে সবাই হাতে হাত রেখে গাইবে সেই গান। খোলা আকাশে ছড়িয়ে পড়বে সেই গান! পরস্পরের হাত ধরার গান, পরস্পরকে ভালোবাসার গান, মুক্ত পৃথিবীর মুক্ত ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে পৃথিবী-সংগীত গাইব আমরা সবাই মিলে। সেই গান বলবে-
         পৃথিবীই মহত্তম
             পবিত্র তার ভালোবাসা,
         ভাবনার প্রতিটি স্তরে
             পৃথিবী ছড়ায় মধু- আশা
পৃথিবীর এই সংগীত মুছে দেবে সব ব্যবধান, হয়ত খুব শিগগিরই এমন একটা দিন আসবে, যেদিন স্কুলে-স্কুলে তাদের নিজস্ব প্রার্থনা সংগীত ছাড়াও এই পৃথিবী-সংগীত গাওয়া হবে! ঘরে, বাইরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রতিটি স্কুলে প্রত্যেক ক্লাসের ছেলেমেয়েদের জন্য থাকবে পৃথিবী কে নিয়ে থাকবে একটা করে স্পেশাল ক্লাস। সেই ক্লাস প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ে অ্যাটেন্ড করবে, না বাধ্য হয়ে নয়, অ্যাটেনডেন্স এর পার্সেন্টেজ কম হওয়ার ভয়ে নয়; তারা সেই ক্লাস অ্যাটেন্ড করবে স্বেচ্ছায়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসায় আর মনের টানে।