।। চতুর্থ।।

কোন বংশ বা কোন পরিবারে যখন প্রথম সন্তান আসে, তখন সেই পরিবারের লোকেরা দারুন খুশিতে উৎসব করে। তার পরে পরে যতজন মানুষ আসে, সেই মানুষটিকে, তারা শুধুমাত্র তাদের অগ্রজ বলেই একটা গুরুত্ব দেয়, তাকে মান্য করে। মানুষের পারিবারিক জীবন ও পারিবারিক বন্ধনের মূল ভিত্তিই হলো অগ্রজকে সম্মান করা। এটাই যদি হয় মানুষের রীতি, যে, পাঁচ বছর বা দশবছরের বড় যদি কেউ হয়, তাকে যদি পরিবারের বড় বলে মেনে নেওয়া হয় এবং তাকে বড়র সম্মান দেওয়া হয় তাহলে যে গাছ আমাদের অনেক অনেক আগে পৃথিবীতে এসেছে সেই গাছ আমাদের কাছে অগ্রজ বলে পরম সম্মানিত হবে না কেন? এমন তো হতেই পারে যে, পরিবারের সব থেকে বড় বলে সম্মানিত সদস্যের, পরিবারে তেমন কোন অবদান নেই, বা বড় হওয়ার কারণেই হয়তো সেই সদস্য কিছু বিশেষ সুবিধা ভোগ করে, অথচ বৃক্ষ এই সমগ্র মানবজাতির থেকে অনেক আগে এই পৃথিবীতে আশা সত্বেও, বিশেষ সম্মান বা সুবিধে ভোগ করা তো অনেক দূরের কথা, লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি গাছ মানুষের হাতে কাটা পড়ছে চিরকাল, আরএই ভাবেই মানুষের হাতে মৃত্যুবরণ করে, মানুষের থেকে অনেক অনেক আগে এই পৃথিবীতে আসার মাশুল গোনে তারা। মানুষ শ্বাস ত্যাগ করে, বাতাসে মিশিয়ে দেয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড নামক মারণ গ্যাস। যে গ্যাস মানুষের শরীরে গেলে মানুষের মারাত্মক ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। সেই প্রাণঘাতী কার্বন-ডাই-অক্সাইড গাছ শুষে নেয় আর আমাদের উপহার দেয় প্রাণদায়ী অক্সিজেন। শ্বাসকষ্ট হলে কোন হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে গেলে কিছু সময়ের জন্য, সেই প্রাণদায়ী অক্সিজেনের বিনিময়ে আমাদের মূল্য দিতে হয়। অথচ গাছ একটা মানুষের ষাট,সত্তর বা আশি বছরের জীবনে যে পরিমাণ অক্সিজেন দিনরাতের প্রতিটি মুহূর্তে সরবরাহ করে তার দান যে বেশ কয়েক কোটি টাকা, সেটা তো আমরা অংকে খুব পাকা না হলেও বলে দিতে পারি! এই জীবনদায়ী মহৎ পরিষেবার মাধ্যমে অগ্রজের দায়িত্ব কি অসামান্য ভাবেই না পালন করে গাছ, বিনিময়ে কিছু আশা না করে উপরন্তু প্রাণদানের মধ্যে দিয়ে তার পরিষেবা পরম পরিপূর্ণতায় পৌঁছায়। এখন কিছু রেনফরেস্ট বা বৃষ্টিবনের কথা আমরা আলোচনা করবো এই অধ্যায়ে।


অরন্যের বৃষ্টিপাত অথবা বৃষ্টিপাতের অরণ্য! অরণ্য মানে আমরা কমবেশি সকলেই জানি; বিশাল বিশাল প্রাচীন গাছ যেখানে একসাথে এক বিরাট অঞ্চলজুড়ে সহাবস্থান করে এবং নানা বন্য পশু-পাখি সরীসৃপ অজস্র প্রজাতির জীবজন্তু এবং প্রাচীনকালে এই জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া নাগরিক সভ্যতার সংস্পর্শ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করা তথাকথিত অর্ধসভ্য কিছু মানুষের আশ্রয়স্থল! এই অরণ্যকে আমরা তথাকথিত নগরকেন্দ্রিক মানুষরা অবহেলা করি, অস্বীকার করি এবং ধ্বংস করি। অথচ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই সুবিস্তৃত অরণ্যগুলি উন্নত নাগরিক সভ্যতার রসদ যুগিয়েছে, জীব বৈচিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, জীবজগতের অস্তিত্ব ও বৈচিত্র্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছে অথচ মানুষ তার সীমাহীন লোভের কারণে এই বিপুল অরণ্য ধ্বংস করে চলেছে আর ডেকে আনছে নানা ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ।আজ এইরকমই দশটি রেনফরেস্ট বা বৃষ্টিবনের কথা নিয়ে এই অধ্যায়ে আলোচনা করবো আমরা। পৃথিবীর বিপুল অংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কে নিয়ন্ত্রণ করে এই রেনফরেস্ট।


এই রেনফরেস্টগুলির অন্যতম হলো অ্যামাজন রেনফরেস্ট।পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেনফরেস্টের অন্যতম এই অ্যামাজন রেনফরেস্ট। নর্থ ওয়েস্টার্ন ব্রাজিলের এক বিশাল অঞ্চল (প্রায় দু’লক্ষ বর্গ মাইল) জুড়ে এই জঙ্গলের অবস্থান। যার বেশির ভাগই ব্রাজিলের মধ্যে অবস্থিত। অ্যামাজনের কিছুটা অংশ কলম্বিয়া, পেরু এবং অন্যান্য সাউথ আমেরিকান দেশের মধ্যে রয়েছে। এই পৃথিবীর অর্ধেক এরও বেশী রেনফরেস্টের প্রতিনিধি অ্যামাজন রেনফরেস্ট। সারা বিশ্বের অক্সিজেনের সামগ্রীকে চাহিদার মোটামুটি কুড়ি শতাংশ জোগান দেয় এই রেনফরেস্ট এবং পরিবেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নেয়। অর্থাৎ এক অতি বৃহৎ অক্সিজেন সিলিন্ডারের কাজ এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের শোষণের কাজ করে এই অ্যামাজন রেনফরেস্ট। একই সাথে প্রাণ বাঁচায় আবার নীলকন্ঠ হয়ে বিষাক্ত গ্যাস শুষে নেয় নিজের শরীরে। পৃথিবীর উপহার আমরা মানুষেরা অকুণ্ঠ ও অকৃতজ্ঞ চিত্তে গ্রহণ করেছি, আবার সেই সাথে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস করে চলেছি এই মহৎ বন্ধুকে, আমাদের লোভ ও স্বার্থপরতার বলি করেছি নগর সম্প্রসারিত করার জন্য! তার যাবতীয় সম্পদসহ পৃথিবী কে আমরা ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ করে নিয়েছি! ধরেই নিয়েছি আমাদের সেবা করতে বাধ্য! যেন আমরা তাকে সৃষ্টি করেছি আমাদের যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ দেখার জন্য! আর তার বেতন হিসেবে ঠিক করেছি, যে জঙ্গল আমাদের ফুসফুস হিসেবে কাজ করছে তাকেই পোড়াচ্ছি বিধ্বংসী আগুনে, ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে পাহাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে প্রাপ্য মেটাচ্ছি, অপরিসীম দূষণে ক্লেদাক্ত করছি সমুদ্রকে- কিন্তু সেই সঙ্গে একটা চরম হুঁশিয়ারির কথাও আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল- পাপের বেতন মৃত্যু! আমাদের একটু কেটে ছিঁড়ে গেলে জন্মধাত্রী মা ব্যাকুল হয়ে ওঠে; ঠিক তেমনি ভাবেই পৃথিবীর সম্পদে র উপর আমরা নির্মম অত্যাচার যখন চালাতে থাকি তখন সর্বংসহা পৃথিবীরও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে আর সেও আমাদের প্রাপ্য মেটায় এবং বুঝিয়ে দেয় তার কাছে আমাদের অবস্থান ঠিক কোথায়। কত তুচ্ছ আমরা, কত নগণ্য! তখন হাতজোড় করে, মাথা নীচু করে তার সামনে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না আমাদের সামনে! রুদ্ররূপিণী পৃথিবী কতক্ষণে শান্ত হবে সেই প্রতীক্ষার প্রহর গুনি আমরা।


এবারে যে রেনফরেস্টটি নিয়ে আলোচনা করব তার নাম হলো কঙ্গো রেনফরেস্ট। আফ্রিকার এই রেনফরেস্ট এর পরিধি প্রায় দেড় লক্ষ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল। ডিফরেস্টেশন বা বাংলায় যাকে বলা যায় জঙ্গল কেটে, বিশাল বিশাল গাছ কেটে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে এবং জঙ্গল পরিষ্কার করার প্রক্রিয়ার ফলে এই সুবৃহৎ অঞ্চল একটি অত্যন্ত বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে এবং পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ক্ষেত্রে এই অঞ্চলটির একটি মারাত্মক ভূমিকা থেকে যাবে যদি এভাবেই ডিফরেস্টেশন বা সাদা বাংলায় জঙ্গল ধ্বংসের কাজ চলতেই থাকে।


এখন আমাদের আলোচনায় বসোয়াস বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। নিকারাগুয়ার উত্তরে পাঁচলক্ষ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে এই রেনফরেস্টটি অবস্থিত। এই রেনফরেস্টের আয়তন একে পৃথিবীর বৃহত্তম রেনফরেস্টগুলির অন্যতম বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেস্কো বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ হিসাবে উনিশশো সাতানব্বই সালে এই রেনফরেষ্টটি স্বীকৃতি পায়।


এবারে আসা যাক  ডেনট্রি রেনফরেস্টের কথায়। একশো পঁয়ষট্টি লক্ষ বছর আগের এই  রেন ফরেস্টকেই  বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম ট্রপিক্যাল রেন ফরেস্ট। ভূতত্ত্ববিদ ও চিত্রগ্রাহক ডেনট্রির নামে এই রেন ফরেস্টের নামকরণ করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের সমুদ্রতটে অবস্থিত এই প্রাচীনতম রেন ফরেস্ট।


ভারত থেকে সুদূর মালয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত রেন ফরেস্ট হল সাদার্ণ এশিয়ান রেন ফরেস্ট। এই রেন ফরেস্টের অধিকাংশ অংশই ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে অবস্থিত। এর অনেকখানি অংশই যদিও আজ নাগরিক সভ্যতার প্রসার ও প্রয়োজনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে কিন্তু একটা সময় এই রেনফরেস্ট বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়েই জীব ও জীবনের বিভিন্নতা ও পরিবর্তনশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো।
টংগাস ন্যাশনাল ফরেস্ট। এই ন্যাশনাল ফরেস্ট এর অর্ধেকটাই রেনফরেস্ট হিসেবে স্বীকৃত। আর বাকি অংশে পর্বত, বরফ এবং জল রয়েছে। আলাস্কার উচ্চতম গাছগুলি এখানে অবস্থিত এবং এগুলির মাত্র পঁচিশ শতাংশ আজ সুরক্ষিত অবস্থায় আছে। সমুদ্রতটের এগারো হাজার মাইল জুড়ে এই রেনফরেস্টের অবস্থান এবং কমবেশি বত্রিশটি গোষ্ঠীর প্রায় পঁচাত্তর হাজার লোকের আশ্রয়স্থল এই  বৃষ্টিবন ভূমি।
কিনাবালু ন্যাশনাল পার্ক। মালয়েশিয়ার এই পার্কটি মালয়েশিয়ার প্রথম জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়। একশো তিরিশ লক্ষ বছরের প্রাচীন এই রেন ফরেস্টটি হাজার হাজার ধরনের গাছ ও অজস্র রকমের প্রাণীর আবাসভূমি হিসেবে সারা পৃথিবীতে পরিচিত।


মন্টেভারডে ক্লাউড ফরেস্ট রিজার্ভ। কোস্টারিকায় অবস্থিত। এই অঞ্চলটিকে ১৯৭২ সালে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এই বনাঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য। এই অঞ্চলে রয়েছে নদী এবং নানা রকমের প্রচুর গাছ। শুধু তাই নয়, এই বনাঞ্চলে নানা রকমের নানা বৈচিত্র্যের প্রচুর পাখি দেখা যায়, যা এই অঞ্চলটিকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পক্ষী নিবাস ও পাখি দর্শনের অত্যন্ত লোভনীয় একটি স্থানে পরিণত করেছে।


আরো একটি রেনফরেস্ট। সিনহারাজা  রিজার্ভ ফরেস্ট। শ্রীলংকার রেনফরেস্ট হাজার উনিশশো আটাত্তর সালে ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্বে ঐতিহ্যপূর্ণ অঞ্চল বলে ঘোষিত হয়। শ্রীলংকার এই জাতীয় উদ্যানে যে বিপুল পরিমাণ গাছ আছে, তার ষাট ভাগই এই অঞ্চলেরই গাছ এবং এই গাছগুলোর মধ্যে অনেক গাছই অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য গাছের মর্যাদা পেয়েছে।


একেবারে শেষে যে রেনফরেস্টের কথা নিয়ে আমরা আলোচনা করবো তা হল ভালডিভিয়ান টেমপারেট রেনফরেস্ট। সাউথ আমেরিকার পশ্চিম সমুদ্রতটে অবস্থিত এই রেনফরেস্ট চিলি থেকে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত বিস্তৃত।


এই রেনফরেস্টের অন্তর্গত চার চারটি রেনফরেস্ট। যেমন পাটাগোনয়ান আন্ডিয়ান রেনফরেস্ট, নদার্ন পাটাগোনয়ান ফরেস্ট, ডেসিডুয়াস ফরেস্ট এবং লরেল ফরেস্ট।


যে দশটি রেনফরেস্ট নিয়ে এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করলাম এরা জীব বৈচিত্র নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক ও জৈবিক ভারসাম্য বজায় রাখা, অক্সিজেনের চাহিদার জোগান দেওয়া- এককথায় সমগ্র জীবজগতের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, সেই মহান বন্ধুদের কিন্তু আমরা উপহার দিই নির্মম মৃত্যু। আবার গর্ব করে, গলা উঁচু করে বলি- আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করেছিলেন গাছের প্রাণ আছে। গাছের প্রাণ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি কি তাদের হত্যার নিদানও দিয়ে গিয়েছিলেন! আমাদের কাজের মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে কি তাঁর মহত্তম আবিষ্কারকেই কলঙ্কিত করছিনা আমরা? আমার তো প্রতি মুহুর্তেই মনে হয়, লজ্জাবতী লতার গায়ে হাত ছোয়ালে সে যে কুঁকড়ে যায় তা কিন্তু লজ্জায় নয়। কিছুতেই নয়। আসলে সে ঘৃণায় কুঁকড়ে যায়। কারণ সে জানে, এই মুহূর্তে যে হাত তার গায়ে স্নেহের স্পর্শ দিচ্ছে, হয়তো পরের মুহূর্তেই ওই  হাতই তাকে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে দেবে! তাই ঘৃণায়, আশঙ্কায় কুঁকড়ে যায় সে আর মনে মনে এক দুই করে মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে হয়তো এই পৃথিবীতেই নীরবে নালিশ জানায়- মানুষের অগ্রজ করে তুমি আমাদের পাঠালে, তা কি, তাদের জীবন বাঁচানোর আর তাদের হাতেই মৃত্যুবরণের? আমার এই বাগান রাজসভার সভাসদরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন এই উত্তরই খোঁজে।