আঃ! আমার নিজের হাতে তৈরি এই বাগানটায় এসে বসলেই কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়! এই পড়ন্ত বিকেলে সূর্য যখন মায়াবী আলোয় ভরিয়ে তুলেছে চারপাশ, গাছের সবুজ পাতায় সোনালী আলোর আভা, এক মায়াময় রূপকথার সৃষ্টি করেছে; আমার কেমন মনে হয় ঝিরিঝিরি হালকা হাওয়ায় গাছেরা হাত তুলে অভিবাদন জানায় এই আলো ও শক্তির উৎসকে আর পরের দিনের জন্যে আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি আর ভাবি এই যে চিরন্তন খেলা, এর আদি অন্ত নেই! আপন খেয়ালে প্রকৃতি কৃত্রিম রং, তুলি আর ক্যানভাস ছাড়াই বিশ্বব্যাপী রচনা করে চলেছে মহার্ঘ্যতম শিল্প। আবেগে চোখ বুজে আসে আমার। মনে হয় আমি যেন ইতিহাসের সেই অতি বিখ্যাত রাজা বিক্রমাদিত্য আর বিক্রমাদিত্যের রাজসভা আলো করে থাকা সেই নবরত্নের মতোই আমার চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অনেক অনেক রত্ন! তবে তফাৎ শুধু এই যে সেই সভাসদদের মধ্যে এক একজন ছিলেন এক এক বিষয়ে পণ্ডিত আর রাজার সঙ্গে তাঁদের ছিল দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক। রাজঅনুগ্রহেই তাঁদের জীবন অতিবাহিত হতো। তাঁদের ছিল নিজের নিজের পাণ্ডিত্যের প্রতি অহঙ্কার আর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এক চোরাস্রোত বইত তাঁদের মধ্যে! কিন্তু আমার এই রাজসভায় সবাই সমান। সবাই এক। সে শিশু চারাগাছই হোক বা বড় পূর্ণবয়স্ক গাছ। আমি এদের মনের ঘরের রাজা। তাই আমি এদের যতটা ভালোবাসি, আমাকেও এরা ঠিক ততোটাই ভালোবাসে। আমাকে এরা দু’হাত ভরে দিয়ে যায়। বিনিময়ে দাবি করে না কিচ্ছু! আমার মনে হয় কত কথা। এই গাছই আমাদের, এই মানুষ নামক জীবদের কোটি কোটি বছর ধরে আশ্রয় দিয়েছে, সূর্যের অতি উচ্চ তাপ থেকে বাঁচিয়েছে মাতৃস্নেহে, আহার যুগিয়েছে, ভয়ঙ্কর ঠান্ডায় আগুনে পুড়েছে আর উষ্ণতা দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে মানুষের। পুরাণে উল্লেখ আছে দধীচি মুনি তার শরীরের হাড় দান করেছিলেন দেবতাদের, সেই হাড় দিয়ে বজ্র তৈরি করে অসুর নিধনের জন্যে! অথচ এই যে কোটি কোটি দধীচি আবহমান কাল থেকে আমাদের বাঁচিয়ে আসছে; কই, তাদের কথা তো সেইভাবে আমরা বলি না কখনো! একটা বিশেষ কোন দিনে যখন সাড়ম্বরে বৃক্ষরোপণ উৎসব হয় তখন দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে সেই মুহূর্তেই চলে বৃক্ষনিধন। এও এক উৎসব, তবে ধ্বংসের উৎসব, মৃত্যুর উৎসব! এমনি কত কথা ভিড় করে আসে আমার মনে! কর্মসূত্রে পৃথিবীর নানা প্রান্তে আমি গিয়েছি, পরিচিত হয়েছি নানা মানুষের সাথে। তাদের আচার-আচরণ, রুচি, সামাজিক ও ধর্মীয় ও রাজনীতি আমাকে কখনো অবাক করেছে, কখনো মুগ্ধ করেছে আবার কখনো নিজের মনে জন্ম নিয়েছে অনেক প্রশ্ন- যার উত্তর আমি নিজে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি মানুষের সাথে আলাপচারিতার মধ্যে দিয়েই। ছোটবেলা থেকেই জেনারেল নলেজ এর বই আমরা সবাই পড়েছি এবং প্রানপণে মুখস্ত করার চেষ্টা করে এসেছি, পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত, দীর্ঘতম রেলপথ, উষ্ণতম অঞ্চল, শীতলতম অঞ্চল, পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ ইত্যাদি। বয়সের সাথে সাথে সে সবের অনেক কিছুই ভুলে গেছি। তবে দুটি বিষয় মনে খুব স্পষ্ট করে গেঁথে আছে। এক, বিশ্বের প্রাচীন সপ্তম আশ্চর্য আর পৃথিবীর বর্তমান সপ্তম আশ্চর্য। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক কিছুই জেনেছি, যা যুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে উন্নত হয়েছে মানুষ, দেশে দেশে ততই তার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেছে সে। জেনেছি সেইসব রেনফরেস্টের কথা যা পৃথিবীর অতি বৃহৎ অংশকে বৃষ্টিপাতে সাহায্যের মধ্যে দিয়ে সজীব করে রেখেছে। জানতে পেরেছি অতি উচ্চ কিছু স্ট্যাচু ও বিল্ডিং এর কথা, অতি সুন্দর, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে ভরপুর অনেক স্থানের কথা এবং বেশ কিছু পবিত্র স্থানের কথা। এর অনেকগুলোই আমরা জানি আবার কিছু হয়তো অজানা অনেকের কাছে। এগুলো নিয়ে আলোচনা করবো আমরা। আলোচনা করবো সেই পবিত্রতম সুন্দরতম পৃথিবীকে নিয়ে, যা যুগ যুগ ধরে ধারণ করে রেখেছে এই সব সৌন্দর্য ও সৃষ্টিকে। এর মাঝেই বারবার ফিরে আসবো নাটশালে। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার একটি অখ্যাত অঞ্চল। আমার জন্মস্থান।