প্রকাশকের কলমে

“থাকলে কাছে কে আর বোঝে ? কিন্তু হারিয়ে গেলে সবাই খেঁাজে।” — না, এটা কোনো ধাঁধা নয়, বরং বাস্তবিক সত্য আমাদের মতো কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, যারা দৈনন্দিন জীবনে কোন কিছু বিনা আয়াসে পেয়ে গেলে তার মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন না।  যেমন ধরুন আপনার হঠাৎ প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হল. ডাক্তারবাবু বললেন, আপনাকে এখনই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অক্সিজেন নিতে হবে। আপনি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে একগাদা টাকা খরচা করে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাহায্য নিয়ে  সুস্থ্য হয়ে উঠলেন। আর তার জন্য আপনি ডাক্তারবাবুকে অজস্র ধন্যবাদ জানালেন সঠিক সময়ে সঠিক পরামৰ্শ দেওয়ার জন্য (অবশ্যই ফি সমেত)। কিন্তু অবাক ব্যাপার ওই কয়েক ঘন্টার বাইরে আপনাকে যে সারাটা জীবন অক্সিজেন যুগিয়ে গেল সেই পৃথিবী বা প্রকৃতিকে একটিবারের জন্যও কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জানাবার কথা অাপনার মাথাতেও এল না। আসবেই বা কি করে, এটা পাওয়া তো আপনার জন্মগত অধিকার। শুধু কি অক্সিজেন সরবরাহ করা, আমরা পৃথিবী বা প্রকৃতির কাছ থেকে কতভাবেই না উপকৃত হচ্ছি সারাটা জীবন ধরে এবং তাও আবার সম্পূর্ণ নিঃখরচায়। আর তার প্রতিদানে আমরা আমাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই পৃথিবীর উপর, প্রকৃতির উপর কতই না অত্যাচার অবিচার করে চলেছি অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে।


আবার দেখুন এই পৃথিবীর উপর কত না স্মৃতি, সৌধ, মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে বা হয়ে চলেছে প্রতি নিয়ত। কখনো তা কোন বিদগ্ধ ব্যক্তির স্মৃতির উদ্দেশ্যে, কখনো বা কোন যুদ্ধ বিজয়ের পরিমণ্ডলে আবার কখনো বা কোন ধর্মের বাতাবরণে। যাঁর বা যে উদ্দেশ্যে এইসব মূর্তি বা স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয় তার নিশ্চয় একটি যুক্তিসম্মত কারণ বা উদ্দেশ্য আছে এবং কোন সন্দেহের অবকাশ নাই সেইসব মহৎ উদ্দেশ্যকে নিয়ে। কিন্তু আমরা কখনো কি ভেবে দেখেছি এই ধরিত্রী মাতা পৃথিবীকে নিয়ে! যিনি এই সব স্মৃতিসৌধ, মূর্তিগুলিকে ধারণ করে আছেন তাঁর বুকে, সেই পৃথিবীমাতার উদ্দেশ্যে একটা সৌধ নির্মাণ করার কথা, যার মাধ্যমে যে কোন ভাষাভাষীর মানুষ, যেকোন ধর্মের মানুষ বা যে কোন দেশ বা মহাদেশের মানুষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারবেন এই মহান ধরিত্রীমাতাকে, যিনি ধারণ করে আছেন আমাদের সকলকে, নিরন্তর যোগান দিয়ে চলেছেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিষেশে জল, আলো, বাতাস অকৃত্রিম এবং অকৃপণভাবে।  

 
তবে এই অন্ধকারের মধ্যেও একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে যে কিছু কিছু মানুষ ব্যক্তিস্বার্থের উর্দ্ধে উঠে একার পক্ষে যতটা সম্ভব মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন করার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। আলোচ্য বইয়ের লেখক মাইকেল তরুণ এধরনেরই এক ব্যক্তিত্ব। পৃথিবীকে ভালোবেসে নিজের তাগিদে গাঁটের কড়ি খসিয়ে একের পর এক বই লিখে যাচ্ছেন, এই আশায় যে একদিন না একদিন এই সব তথাকথিত সভ্য, শিক্ষিত এবং জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে সংশোধনের চেষ্টা করবেন।


মাইকেল তরুণ সুদীৰ্ঘদিন পৃথিবীকে নিয়ে কাজ করার সুবাদে আরও একটি নতুন ভাবনায় উপনীত হয়েছেন যে পবিত্রতম ভাবনার পবিত্রতম ফসল পবিত্রতম কাজ। পবিত্রতম পৃথিবীর পরম পবিত্রতার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে তার সমগ্র সৃষ্টিতে। উনি মনে করেন খন্ড, ক্ষুদ্র অংশ নয় সমগ্র পৃথিবীই পবিত্রতম। এই ভাবনাই এই উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য।


ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করতে চাইনা মাইকেল তরুণের এই অসাধারণ প্রয়াসকে। কুর্নিশ জানাই তাঁর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার এই মহৎ প্রচেষ্টাকে। পৃথিবীকে সুস্থ্য রাখার, পৃথিবীকে অবোধ কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের লোভের হাত থেকে রক্ষা করার যে ব্রত মাইকেল তরুণ নিজের ছোট কাঁধে তুলে নিয়েছেন কোন প্রশংসাই তার জন্য যথেষ্ঠ নয়। তবে আমরা সবসময় তাঁর এই মহৎ উদ্যোগের পাশে আছি এই বার্তাটুকু জানাতে চাই। আর চাই আপনারাও সামিল হোন এই মহৎ আন্দোলনে।


এছাড়া একজন প্রকাশকের তরফ থেকে যে যে বিষয়গুলি এই নিবেদন পত্রে উল্লেখ করার প্রয়োজন সেই সূত্রে ধন্যবাদ জানাই প্রচ্ছদ শিল্পী বিভাস বৈদ্য, প্রচ্ছদ ও পেন্সিল ড্রইং-এর শিল্পী রডরিক ফার্ণান্ডো ওরফে অভিজিৎকে এবং অবশ্যই সহলেখক দেবাশিস বন্দোপাধ্যায়কে। এনাদের প্রত্যেককেই কৃতজ্ঞতা জানাই মাইকেল তরুনের এই বলিষ্ঠ কর্মকাণ্ডের পাশে সহযোদ্ধা হিসেবে থাকার জন্য।


সবশেষে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই বইটি শুধুমাত্র সাহিত্যগুণে নয় বিষয় বৈচিত্র্যেও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে আর সেইসঙ্গে লেখকের স্বপ্ন এবং উদ্দেশ্যকে সফল করে ভবিষ্যতে আরও অনেকে তাঁর এই আন্দোলনে সামিল হবেন।  

সুকুমার গুপ্ত
নলেজ ব্যাঙ্ক পাবলিশার্স এ্যাণ্ড ডিস্ট্রিবিউটরস
কলকাতা