।। একবিংশ।।

অন্ধ আমি ভালবাসায়
অন্ধ আমি প্রেমে
অন্ধ আমার ভালবাসায়
মা যে এল নেমে
অন্ধ হয়ে ভালো আছি
চাইনা আমি দৃষ্টি
আমার মাথায় ঝরুক তোমার
ভালবাসার বৃষ্টি

নদীর পাড়ে বসে বিভোর হয়ে গান গেয়ে চলেছে স্বপন, আর চোখ বুজে গাছে ঠেস দিয়ে বসে গান শুনছেন মহীধরবাবু। আর এই পড়ন্ত বিকেলের আলো যেন নীরব সাক্ষী  হয়ে তাকিয়ে আছে এক সাধক গায়ক আর এক সাধক শ্রোতার দিকে। গান শেষ করে নদীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে থাকে লালন। চুপ করে থাকেন মহীধরবাবু। এইভাবে কেটে যায় কয়েকটা মুহূর্ত। সোজা হয়ে বসেন মহীধরবাবু। স্বপনের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলেন, ‘কি করে পেলে তুমি এমন উপলব্ধি! এই দর্শন তো পৃথিবীর দার্শনিকদের সাথে এক আসনে বসাতে পারে তোমায়?’ জিভ কেটে তাড়াতাড়ি মহীধরবাবুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে স্বপন, বলে,
‘স্যার, আমায় আপনি এভাবে লজ্জা দেবেন না! আপনিই তো আগের দিন বললেন ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে এই পৃথিবীতে কত অন্যায়, কত ধ্বংস, কত ক্ষতি, কত মৃত্যু হয়েছে- কিন্তু মানুষ মানুষের প্রতি ভালবাসায় অন্ধ না হয়ে যদি এই পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ হত তাহলে কোন ক্ষতি তো হতোই না, বরং অনেক অনেক বেশি লাভবান হতো!’
হাসি মুখে তাকিয়ে থেকে মহীধরবাবু বলেন, ‘বইতে লেখা ভালো ভালো কথা যদি দুই মলাটের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকত, মানুষ যদি তা আত্মস্থ করতে না পারতো, যদি কোন গঠনমূলক চিন্তাকে মানুষ নিজের বলে ভাবতে না পারতো, তাহলে মানব-সভ্যতা এত দূরে পৌঁছাতেই পারত না! তুমি তা পেরেছ স্বপন! একমাত্র পৃথিবীকে অন্ধভাবে ভালোবাসলেই সে প্রতিদানে অজস্র ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে, আর আমাদের বেঁচে থাকাকে সহজ, সুন্দর, অবাধ করে তুলবে। এই পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে পৃথিবী-পথে চালিত করবে, যে পথ ইট, কাঠ, সিমেন্ট, বালি, রড দিয়ে তৈরি নয়। এই পথ আগাগোড়াই ভালবাসায় মোড়া।
প্রিয় ডায়রির পাতা খুলে প্রায় আধঘন্টা ধরে বসে আছেন মহীধরবাবু। কি লিখবেন সেটা খুব স্পষ্ট, কিন্তু কিভাবে লিখবেন সেটা স্থির করতে পারছেন না! আসলে গতকাল স্কুলে এমন ঘটনা ঘটেছে, যেটা গোটা স্কুলেই তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গতকাল আচমকাই জরুরী টিচার্স মিটিং ডেকেছিলেন  সম্বিতবাবু। সেখানেই জানা যায়, শিক্ষা দপ্তর থেকে চিঠি এসেছে, অরুণ সেন আর জীবন জোয়ারদার বলে যে দু’জন শিক্ষক তিন বছর আগে স্কুলে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট পেয়েছেন, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার শংসাপত্র নাকি জাল! সম্প্রতি তদন্তে তা ধরা পড়েছে। কোর্টের কেস চলাকালীন এবং বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঐ দু’জন শিক্ষককে ক্লাস না নেওয়ার এবং স্কুলে না আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে সম্বিতবাবু অবিলম্বে যেন ঐ নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেন। এই বিষয়টি জানার পর থেকে মহীধরবাবুবাবু শুধু একটা কথাই ভেবে চলেছেন- যারা ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায়-নীতি মূল্যবোধের শিক্ষা দেবে, তাদের দিকেই যদি অন্যায় এবং নীতিভ্রষ্টতার অভিযোগ ওঠে, তাহলে শিক্ষক হিসাবে নিজের পরিচয় কিভাবে দেওয়া যাবে? যিনি শিক্ষা দেন,অবশ্যই সুশিক্ষা, তারাই তো সমাজে শিক্ষক বলে মর্যাদা পান! এই ন্যায়-নীতিহীনতা, এই চালবাজি, এই চালাকির কি কোন দরকার ছিল? আর শুধু তো এই শিক্ষক সমাজে নয়, বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক ক্ষেত্র এবং সমাজের প্রায় সর্বক্ষেত্রেই এই ধরনের চালাকি, মিথ্যা ও অবক্ষয় প্রায় সমার্থক হয়ে দাড়িয়েছে। কিন্তু একটা কথা মানুষ যে কেন কিছুতেই বোঝেনা, এই ধরনের চালবাজি, চালাকি বা অসৎ পন্থার মেয়াদ অল্প কিছুদিনের  জন্য, বেশি দিনের জন্য বা অনেক দিনের জন্য হতে পারে কিন্তু চিরস্থায়ী কিছুতেই হতে পারে না। চিরস্থায়ী ছাপ ফেলার মতো ভালো কিছু করতে হলে মানুষকে হতে হবে স্বচ্ছ এবং সৎ। আর তা হতে গেলে উদাহরণ হিসেবে আমাদের হাতের কাছেই তো রয়েছে প্রকৃতির অজস্র দান। একটা ফুল, একটা প্রজাপতি, ঝর্ণার জল বা ছোট্ট পাখির শিস, সবই স্বচ্ছ আর অকৃত্রিম। তাদের  না আছে চালবাজি, আর না আছে চালাকি। এই পৃথিবী স্বচ্ছতার প্রতিমূর্তি আর অজস্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তারই প্রতিরূপ। শেষ লাইনটি লিখে কয়েক মুহুর্ত ডাইরির দিকে তাকিয়ে থাকেন মহীধরবাবু, তারপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকান স্বচ্ছ, অকৃত্রিম প্রকৃতির দিকে।