‘আচ্ছা স্বপন, তুমি ধর্ম মানো?’ খুব মন দিয়ে বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে আচমকা মহীধরবাবুর প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে মহীধরবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আজ্ঞে?’ হেসে ওঠেন মহীধরবাবু বলেন, ‘আরে আরে, ওইদিকে দেখো; হাওয়ায় খোসার সঙ্গে তোমার বাদামও উড়ে যাবে যে!’
সেরকম অবাক গলাতেই স্বপন বলে, ‘স্যার ধর্ম নিয়ে কি বললেন আপনি?’
‘আমি বললাম,’ হাতের কয়েকটা বাদাম মুখে পুরে দিয়ে মহীধরবাবু বলেন, ‘এই যে চারপাশে ধর্ম নিয়ে এত মাতামাতি, এত শোরগোল, যেন ধর্মের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ তা প্রমাণ করার জন্য; এটা নিয়ে তোমার কিছু মনে হয়েছে কখনো?’ স্বপন একটা ঢোঁক গিলে নিয়ে বলে,
‘স্যার, আমার তো এত জ্ঞান বুদ্ধি নেই, কিন্তু কি মনে হয় জানেন,এইযে চারপাশে সবাই আমার ধর্ম বড়ো, আমার ধর্ম বড়ো বলে চিত্কার করছে, কার ধর্ম বড়ো সেটা কে ঠিক করবে, কি করে ঠিক করবে ?’ খুশিতে মাথা নাড়েন মহীধরবাবু, ‘ঠিক,ঠিক একেবারে ঠিক কথা! দেখো পৃথিবী তৈরি হওয়ার লক্ষ লক্ষ বছর পরেও কিন্তু ধর্ম বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না! তখন ছিল একটাই ধর্ম- প্রাণ বাঁচানোর ধর্ম; বেঁচে থাকার ধর্ম; এরপরে এল ধর্ম! যার অর্থ ধারণ করা! ধর্ম ধারণ করে মানুষের আবেগ, মানুষের ভালোবাসা, মানুষের মনুষ্যত্ব আর তার বিবেক! সেই বিবেক শেখায় সব ধর্মকে দেখতে, সম্মান করতে। কিন্তু দেখো স্বপন সত্যিই কি আমরা তা পারি?’ স্বপন মাথা নাড়ে। মহীধরবাবু বলেন, ‘তাহলে কে পারে সেটা? যে পারে সে হল এই পৃথিবী! এই পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়েই সব ধর্মের উৎপত্তি আর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। কিন্তু এই পৃথিবী পারে সব ধর্মকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে। কারণ তার কাছে ধর্ম মানে একটাই- ভালোবাসার ধর্ম। এই ধর্ম সব ধর্মকেই সমান গুরুত্ব দেয়, সমান মর্যাদা দেয় কারণ পৃথিবীর কাছে প্রত্যেকটি মানুষ সম গুরুত্ব পায় আর ধর্ম তো সৃষ্টি করেছে মানুষ। সুতরাং মানুষের তৈরি সব ধর্মই পৃথিবীর কাছে সমান আদরের, সমান ভালবাসার।’ শেষ করলেন মহীধরবাবু আর মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্বপন। আর তার হাতের পাতায় রয়ে গেছে কয়েকটা খোসা ছাড়ানো বাদাম, কথা শুনতে শুনতে যেগুলোর কথা বেমালুম ভুলেই গেছে স্বপন।
স্কুলের উল্টোদিকে এই চায়ের দোকানটায় মাঝে মাঝে এসে বসেন মহীধরবাবু ক্লাসের অবসরে। কত রকমের মানুষ আসে এই চায়ের দোকানে! কেউ কেউ তার অতি ব্যস্ততার মাঝে এক ভাঁড় চায়ে কোনরকমে একটু গলা ভিজিয়ে নিয়েই চলে যায় তার কাজে। কেউ কেউ আসে, নিছক সময় কাটানোই যার উদ্দেশ্য; এক ভাঁড় চা পাশে রেখে বিস্কুটে একটা করে কামড় দিয়ে সেদিনের খবরের কাগজটা আগাগোড়া মন দিয়ে পড়ে ফেলে! কাগজ পড়তে পড়তে অন্যমনস্কভাবে চায়ের ভাঁড় ধরার বদলে গরম চায়ে হাত ডুবিয়ে ছ্যাঁকা খাওয়ার দৃশ্য বেশ উপভোগই করেন মহীধরবাবু। কারোর সঙ্গেই কথা বিশেষ হয়না, কিন্তু অনেকের অনেক অসংলগ্ন টুকরো টুকরো কথার মধ্যে থেকেও তিনি নিজস্ব ভাবনার রসদ পেয়ে যান! মাঝে মাঝে তো মহীধরবাবুর মনে হয়, চায়ের দোকানটা যেন চলমান পৃথিবীরই এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিরূপ। পৃথিবীতে মানুষ জন্ম নেয়, পরস্পরের সাথে আলাপ পরিচয় হয়, মানুষ নিজের নিজের কাজের পরিসরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর তারপর একটা সময় পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়! এই চায়ের দোকানেও তো তাই! মানুষ কিছু সময়ের জন্য আসে আলাপ, পরিচয়, গল্পগুজব হয়- আবার যে যার গন্তব্যে চলে যায়। যে দুটি মানুষের আজ প্রথম এখানে আলাপ হলো- হয়তো আর কোনোদিনই তাদের আর দেখা হবে না। এইসব ভাবনার মধ্যে হঠাৎই মহীধরবাবুর কানে আসে একজন মাঝবয়সী লোক একজন যুবককে বলছে- ‘প্রতারক, প্রতারক- চারপাশটা প্রতারকে ভরে গেছে বুঝলি! কাগজে প্রতিদিন শুধু প্রতারণার হাজারটা ঘটনা। কে, অসহায় রিটায়ার্ড বৃদ্ধের সারা জীবনের সঞ্চয় প্রতারণা করে ব্যাংক থেকে সব টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, কে আবার চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করছে, আবার কেউ কেউ অনেক বেশি টাকা সুদ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে প্রতারণা করছে; এই কথা শুনতে শুনতে মহীধরবাবুর সারা শরীরের মধ্যে দিয়ে একটা বিদ্যুতের শ্রোত বয়ে গেল। হঠাৎ তাঁর মনে হল, আরে এই কথাটা তো আগে মনে হয়নি! অহরহ একদল মানুষ যেখানে সেখানে মানুষকে ঠকাচ্ছে, প্রতারণা করছে ,আর অন্য একদল মানুষ প্রতারিত হচ্ছে; পৃথিবীর সর্বত্র ঘটে চলেছে এই ঘটনা এবং সেটা একমাত্র মানুষের সমাজেই ঘটে। মানুষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোন জীব, কেউ কারোর প্রতি প্রতারণা কোনদিন করে না! তাদের মধ্যে শত্রুতা, হিংসা, মারামারি সবই আছে, এমনকি খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক আছে এবং নিজেদের মধ্যে প্রচন্ড মারামারির ফলে সাংঘাতিকভাবে আহত এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে; কিন্তু প্রতারণা করার মত কোন ঘটনা মানুষ ছাড়া অন্য কোন জীবের মধ্যে ঘটে না! পৃথিবীর মতো সততা ও পবিত্রতার প্রতিমূর্তির সন্তান হয়েও মানুষ অহরহ প্রতারণা করে চলেছে; কিন্তু মানুষের তুলনায় অতি অনুন্নত জীবেরাও ভালো শিক্ষা নিয়েছে পৃথিবীর কাছ থেকে। তাই মানুষই হল প্রতারক জীব। অন্য কোন প্রাণী নয়। মহীধরবাবুর এই ভাবনার মধ্যেই দোকানদার সামনে এসে দাঁড়ায়, বলে, ‘স্যার আপনাকে একটা চা দিই?’
মুখ তুলে তাকান মহীধরবাবু। হেসে বলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দুধ চিনি দিয়ে একটা স্পেশাল চা হয়ে যাক!’
‘ ঠিক আছে স্যার আমি এক্ষুণি করে দিচ্ছি’। হেসে বলে দোকানদার।
আজ স্কুলের ছুটির পর মিলন মহীধরবাবুর সঙ্গ নিয়েছে। মিলনের সঙ্গে মহীধরবাবুর সম্পর্কটা বেশ মজার! চূড়ান্ত অন্যমনষ্ক প্রকৃতির মানুষটাকে মিলন মনে মনে খুব ভালোবাসে! চাকরিতে তার পোস্টটা স্কুলের পিয়নের হলেও, অনেক সময়ই মিলন মহীধরবাবুর অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে। কোনো সময় জোর করে নদীর পাড় থেকে তুলে ঘরে পাঠাবার ব্যবস্থা করে আবার কোনোসময় জোর করেই মহীধরবাবুকে কিছু না কিছু খাইয়ে দেয়। কারণ মিলন জানে স্কুলে আসার সময় অনেকদিনই তাড়াহুড়োয় না খেয়ে চলে আসেন আর তারপর সারাদিনে হয়তো কিছু খাওয়াই হয়না তাঁর।তবে আজ মহীধরবাবুর সঙ্গ নেওয়ার কারণটা অন্য। আজ মহীধরবাবু আর মধুক্ষরা দিদিমনির একটা আলোচনার খানিকটা শুনেছে মিলন। মধুক্ষরা দিদিমণিকে সবাই খুব কড়া ধাতের বলেই জানে। কোন অন্যায় সহ্য করতে পারেন না। প্রয়োজনে যে কাউকে কড়া কথা শুনিয়ে দিতে পারেন! কিন্তু মিলন জানে, আসলে মধুক্ষরা খুব নরম মনের মানুষ! কতবার সংসারের কতরকম বিপদ-আপদের কথা মধুক্ষরাকে জানিয়েছে মিলন- নানারকম ভাবে সেই বিপদে সাহায্য করেছেন মধুক্ষরা! কখনো ফিরিয়ে দেননি। আজ মধুক্ষরাকে মহীধরবাবু বলছিলেন- ক্ষণস্থায়ী আনন্দ নয়, আমাদের দীর্ঘস্থায়ী আনন্দকেই সব সময় বরণ করে নেওয়া উচিত। এই কথাটাই মিলনের মনে বারবার ঘুরেফিরে আসছে। হাঁটতে হাঁটতে মিলন বলে- ‘স্যার আপনি দুপুরে স্টাফ রুমে মধুক্ষরা ম্যামকে যে বলছিলেন, ক্ষণস্থায়ী আনন্দের দিকে নয়, আমাদের দীর্ঘস্থায়ী আনন্দের দিকেই নজর দেওয়া উচিত; আমি আপনাদের চা দিতে গিয়ে শুনেছিলাম, স্যার এই কথাটার মানে আমাকে একটু বুঝিয়ে দিন না !’
‘ও এটা জানার জন্য আমার সঙ্গ নিয়েছো তুমি আজ?’ হেসে জানতে চানমহীধরবাবু।
‘হ্যাঁ, স্যার,’ মিলনও হেসে ফেলে।
‘আসলে কি জানো মিলন, সাময়িক হৈ-হুল্লোড়, আনন্দ, এইসবে মানুষ শুধু যে সময়, অর্থ ইত্যাদি ব্যয় করে তাই নয়, তবে নানারকম নেশা ইত্যাদির ফলে মানুষ সাময়িক একটা আনন্দ পায় বটে কিন্তু সেটা মানুষকে নানা জটিল রোগ-ব্যধিতে আক্রান্তই করে না শুধু, তার মৃত্যুকেও ডেকে আনে অনেক তাড়াতাড়ি। এটাতো ক্ষতি। শুধুমাত্র ক্ষতি নয়, এটা একরকমের হঠকারিতা। এটা ভুল। এই ভুল কিন্তু শুধরে নেওয়া যায় বা দেওয়া যায়। একটা মানুষ যদি একটাসময় অনুভব করে তার মদ্যপান বা অন্য ধরনের এমন কিছু করা উচিত নয় যা তার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর, তাহলে সে সেটা শুধরে নিতে পারে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী আনন্দকে গুরুত্ব না দিলে বা অবহেলা করলে কিন্তু তার ক্ষতি অতি ভয়ঙ্কর এবং সুদুরপ্রসারি। তা কিছুতেই শুধরে নেওয়া যায় না।’
‘কিন্তু স্যার, এই দীর্ঘস্থায়ী আনন্দটা কি?’
‘দীর্ঘস্থায়ী আনন্দটা হলো, এই পৃথিবীকে নিয়ে আনন্দ করা, পৃথিবীকে ভেবে আনন্দ করা,পৃথিবীর জন্য আনন্দ করা, পৃথিবীকে ভালোবেসে আনন্দ করা। যদি এই পৃথিবীকে ভালবেসে, তাকে আনন্দ দিয়ে, তাকে সুন্দর রেখে আনন্দ পেতে চাই- তাহলে সেই আনন্দ অতি দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং এই বর্তমান সময়ে শুধু নয়, অনেক অনেক পরের প্রজন্মও যারা আসবে তারা অনাবিল আনন্দে নিজেকে ভরিয়ে তুলবে। এবারে তোমার কৌতুহল মিটলো মিলনবাবু?’
একহাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে আর এক হাতে মাথা চুলকোয় মিলন, মুখে অপ্রস্তুতের হাসি।