আজ স্কুলে ঢুকতে না ঢুকতেই সম্বিতবাবু একটা অনুরোধ করলেন মহীধরবাবুকে। বললেন, “মহীবাবু, আজ তো নিলয়বাবু স্কুলে আসেন নি। ঐ ক্লাসগুলো কিন্তু আপনাকেই একটু ম্যানেজ করতে হবে!” আজ মহীবাবুর একটা খুব জরুরী কাজ ছিলো কিন্তু এই মানুষটি, মানে সম্বিতবাবুর অনুরোধ তিনি কখনোই ফেলতে পারেন না! আসলে সম্বিতবাবুর সঙ্গে মহীবাবুর সম্পর্কটা বড়ো অদ্ভুত! পরিচালন সমিতি থেকে শুরু করে, স্কুলের টিচাররা এমনকি ছেলেমেয়েদের অভিভাবকরা পর্যন্ত যখন মহীবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝুড়ি খুলে বসে, তখন বড়ো বিব্রত আর অসহায় বোধ করেন সম্বিতবাবু। বাধ্য হয়ে মহীবাবুর সাথে কথা বলতে হয়, সাবধান করতে হয়, কিন্তু মহীবাবু যখন নিজস্ব যুক্তি দিয়ে তাঁর কথা তুলে ধরেন, তখন প্রত্যেকবারই সম্বিতবাবু অনুভব করেন, এই মানুষটার প্রত্যেকটা কাজের মুখ এবং অভিমুখ এই পৃথিবী এবং যা মহীধরবাবু ভাবেন এবং বলেন তা এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের ভালোর জন্য। ঠিক এই কারণেই মহীধরবাবু রাজি হয়ে যান নিলয়বাবুর ক্লাস নিতে। নির্ধারিত পড়া শেষ করে মহীধরবাবু বরাবরের মতো ক্লাসে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের কারোর কিছু জিজ্ঞাসা করার থাকলে করো।”
সুমিত উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে, “স্যার, নিলয়স্যার সেদিন আমাদের বলছিলেন যে সূর্যের থেকে কিভাবে পৃথিবীর জন্ম হলো এবং সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। এইসব নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে অনেককাল আগে থেকেই নানা তর্ক, মত, বিরুদ্ধ মত, এসব চলছেই। তাহলে স্যার, কে কার উপর নির্ভর করে আছে?” মুচ্কি হেসে মহীধরবাবু বলেন, “বাঃ, দারুণ একটা প্রশ্ন! তোর প্রশ্ন শুনে মনটা ভালো হয়ে গেলো। দেখ এই পৃথিবীর জন্ম কিভাবে হলো তা নিয়ে কিন্তু একটা সর্বজনগ্রাহ্য ও সর্বজনমান্য সিদ্ধান্ত আজও আমরা নিতে পারিনি! পৃথিবীর জন্মের কোটি কোটি বছর পরে মানুষ যখন এ বিষয়ে কৌতূহলী হলো, জানতে আগ্রহী হলো, তখন থেকে কিছু মনগড়া ধারণা, কল্পনা, কিছু প্রমাণ এবং ধীরে ধীরে বিজ্ঞানসম্মত কিছু প্রমাণ, পরীক্ষা নিরীক্ষা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে মানুষ একের পর এক মতবাদ প্রকাশ করে চলেছে।’ একটু হেসে মহীধরবাবু বলল, ‘কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানিস, এতে না পৃথিবী, না সূর্য কারোরই কিছু আসে যায় না। তারা আবহমানকাল ধরে পরস্পরের সাহায্যে, পরস্পরের প্রতি অটুট ভরসা রেখে তাদের কর্তব্য করে চলেছে। সূর্যের আলো, তার তেজ না থাকলে যেমন জীবজগতের কোটি প্রাণী বিপদে পড়ে যাবে, প্রাণসংশয় হয়ে উঠবে ! এ কথা অতীব সত্যি কিন্তু আবার আর একটা দিকও ভেবে দেখ তোরা, এই পৃথিবীর বুকে নানা ভাষার নানা ধর্মের মানুষ আছে, যারা মনে করে সূর্য অসীম শক্তির অধিকারী ! তাদের কাছে সূর্য পূজনীয় ! তারা যে সূর্যকে প্রণাম জানায় তা কিন্তু এই পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়েই। তাতে কিন্তু এই পৃথিবীর মনে হয় না, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এবং তার পরেও আমার আশ্রয়ে থেকে এরা সূর্যকে প্রণাম করছে, আমাকে না প্রণাম করে। তার তো কখনো ঈর্ষা হয় না। আবার অন্যদিকে সূর্যও তো মনে করেনা পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে যখন আমাকেই প্রণাম করছে তখন আমিই শ্রেষ্ঠ! অর্থাৎ তাদের পারস্পরিক সহাবস্থানের ভিত্তি হলো পরস্পরের প্রতি অটুট শ্রদ্ধা, সম্মান ও নিজের নিজের কাজের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা। আমরা যদি এইভাবে পৃথিবী ও সূর্যকে দেখি, তাহলে এই গুণগুলো আমরা আয়ত্ত করতে পারবো আর মানুষ হিসাবে আরও উন্নততর হয়ে উঠবো।” কথা শেষ করে মহীধরবাবু দেখেন ক্লাস জুড়ে পিন পড়ার আওয়াজ পাওয়ার মতো নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে আর সব ছেলেমেয়ে অপলকে তাকিয়ে আছে তাদের মহীস্যারের দিকে।
নাঃ কিছুতেই ক্লাস নিতে পারছেন না মহীধরবাবু। যতবার কিছু বলতে যাচ্ছেন, ততবারই ঢাক-ঢোলের প্রবল আওয়াজে তাঁর কথা চাপা পড়ে যাচ্ছে। ক্লাসের দরজা জানলা সব বন্ধ করে দিয়েও কিছুতেই আওয়াজের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মহীস্যারকে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে ছেলে-মেয়েরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, তারপর সুমন উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমারা সবাই মিলে একবার যাব স্যার মন্দিরে? ওদের বলবো খানিকক্ষণ আওয়াজ বন্ধ রাখতে?’ সুমনের কথা শুনে মহীধরবাবু বিষণ্ণ হাসি হেসে তাকান সুমনের দিকে, বলেন, ‘না রে, ওরা শুনবে না। একটা গন্ডগোল বাঁধবে।’
‘কিন্তু স্যার,’ দীপাঞ্জনা বলে, ‘স্কুলের গায়ে মন্দির, সেখানে যদি এত জোরে ঢাক-ঢোল, কাঁসর বাজে তাহলে আমরা পড়ব কি করে ? হেডস্যার তো এই ব্যাপারে কতবার কথা বলেছেন ওদের সাথে।’
‘হ্যাঁ বলেছেন, কিন্তু ওরা শুনেছে কি ? এই পূজা-অর্চনার ব্যাপার গুলোর মধ্যে এমন একটা আবেগ জড়িয়ে থাকে, একটু এদিক ওদিক হলেই মারামারি, খুনোখুনি পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।’ ‘আচ্ছা স্যার,’ এবার প্রতীক বলে ওঠে, ‘স্যার সবাই যে হাতজোড় করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, কি প্রার্থনা করে স্যার ?’ ছেলে-মেয়েরা হেসে ওঠে প্রতীকের কথা শুনে। ঢাক-ঢোলের প্রচন্ড আওয়াজের মধ্যেই মহীধরবাবু কষ্ট করে প্রতীকের কথা শোনেন, তারপর একটু হেসে বলেন, ‘ তোর কি মনে হয়, কি প্রার্থনা করে ?’ ‘জানিনা স্যার, কিন্তু এত কোটি কোটি মানুষ যে দিনরাত প্রার্থনা করছে, ভগবান কি তাদের সব প্রার্থনা শোনে ? ভগবানের তো আরও কত কাজ রয়েছে।’
‘শোনেনা তো!’ হাসিমুখে বলেন মহীধরবাবু। ছেলেমেয়েরা অবাক তাকিয়ে আছে দেখে বলেন, ‘আমার তো মনে হয় ভগবান উল্টে হাতজোড় করে বলেন, ‘দোহাই তোদের, তোরা আমার কাছে আর কিছু চাস না। তোদের দেওয়ার মতো আমার কাছে আর কিছু নেই। না চাইতেই এই পৃথিবী নামক সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার তোদের হাতে তুলে দিয়েছি। তোদের সব চাওয়া-পাওয়ার আল্টিমেট ডেস্টিনেশন এই পৃথিবী।’ মহীধরবাবুর কথাও শেষ হয়, আর ক্লাস শেষ হওয়ার ঘন্টাও সজোরে বেজে ওঠে। মহীধরবাবু হাসিমুখে বলেন, ‘যাক, এতো আওয়াজের মধ্যেও এই আওয়াজও কিন্তু ঠিক শোনা গেছে !’