।। পঞ্চদশ।।

    অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছে ক্লাস সেভেনের ঋতম। থেকে থেকেই ঋতম হাত তুলে মহীধরবাবুর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এবার মহীধরবাবু ফেরেন ওর দিকে। বলেন, ‘হ্যাঁ, এতক্ষণ তো তোমরা আমার কথা শুনলে, এবার কারোর কিছু বলার থাকলে বলো। ঋতম বলে ওঠে, ‘স্যার, আপনি যে বললেন পৃথিবী ভীষণ অসুস্থ, তাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। আচ্ছা স্যার, আমাদের বাড়ির লোক বা বন্ধু বান্ধব যদি অসুস্থ হয়, তাহলে তো আমরা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, যাতে তাকে সুস্থ করে দেন, স্যার, আমরা যদি পৃথিবীর জন্যেও ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, মন প্রাণ দিয়ে ভগবানকে ডেকে বলি, আমাদের পৃথিবীকে সুস্থ করে দাও, তাহলে তিনি আমাদের কথা শুনবেন না ?’
    ঋতমের কথায় হাসেন মহীধরবাবু, তারপর সস্নেহে বলেন, ‘নারে শুনবেন না। কেন শুনবেন বল ? এই পৃথিবীকে, এই পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর সেই সব কিছু এই পৃথিবীর প্রাণীদের তিনি দান করে দিয়েছেন, আর এই পৃথিবীকে ভালো রাখার সুস্থ রাখার দায়িত্ব তিনি এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষকেই দিয়েছেন। এই পৃথিবীকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন আমাদের। আমাদের বাবা বা দাদু বা আর কেউ যদি আমাদের কিছু দান করে, তখন সেটা আমাদের নিজস্ব হয়ে যায়, আর তার ভালো মন্দের দায়-দায়িত্বও তো আমাদের হয়ে যায়, তাইনা ? ঠিক সেভাবেই এই পৃথিবীর ভালো-মন্দের দায়-দায়িত্বও আমাদেরই। এই ব্যাপারে তাঁর কোনো দায় নেই; আর তাই এ নিয়ে আমাদের কোনো প্রার্থনাই তিনি শুনবেন না। যা করতে হবে আমাদেরই করতে হবে, এই পৃথিবীকে ভালবেসে, আপন ভেবে তাকে সুস্থ রাখার সুন্দর রাখার দায়িত্ব নিতে হবে। এবার তোরা একটা কথা বল, মা হাসিমুখে শান্তভাবে তোদের সব আবদার, সব দুষ্টুমি মেনে নেয়, কিন্তু একসময় অতিষ্ঠ হয়ে মা যখন ভীষণ রেগে যায়, তখন কি করিস তোরা ?’ সায়ন বলে, ‘স্যার, তখন খুব ভয় করে। মাকে যেন চিনতেই পারিনা। দূরে সরে সরে থাকি। অনেক্ষণ পরে মায়ের রাগ কমলে, মা আবার হাসলে মাকে তখন আবার আমার সেই চেনা মা বলে মনে হয়।’
    ‘বাঃ, বেশ সুন্দর গুছিয়ে বলেছিস কথাগুলো। মহীধরবাবু বলেন, ‘আমাদের পৃথিবী মাও ঠিক এই রকম। যখন একেবারে চুপটি করে শান্ত হয়ে থাকে, আমাদের সব আঘাতই হাসিমুখে সহ্য করে ঠিক আমাদের ঘরের মায়ের মতই। কিন্তু সেই পৃথিবীই যখন প্রচন্ড রাগে ভূমিকম্প, প্রবল ঝড়, ভয়ংকর বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে, তখন কিন্তু আমরা তাকে পাল্টা আঘাত করার সাহস পাইনা। সায়ন যেমন ওর মায়ের থেকে দূরে থাকে, ঠিক তেমনি ভাবেই আমরাও সেখান থেকে যতদূরে সম্ভব পালাতে থাকি। পৃথিবীকে আঘাত করার চিন্তা তো অনেক দূরের কথা, আমরা তখন নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পালাই সেখান থেকে। সত্যি কিনা বল ?’
    অমিয় বলে, ‘হ্যাঁ স্যার। একদম সত্যি।
    ‘স্যার, এই কথাটার মানে কি ?’ কল্লোলের প্রশ্নে মুচকি হাসেন মহীধরবাবু। বলেন, ‘কোন কথাটা রে ?’
    ‘এই তো স্যার, রক্ষকই ভক্ষক, এই কথাটা।’ বইটা মহীধরবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে কল্লোল।
    ‘ও, এটার মানে তো খুব সহজ রে। ধর, তোর মা তোকে দশটা রসগোল্লা দিয়ে বললো যে তুই পাঁচটা খাবি আর বাকি পাঁচটা ভাইকে দিবি। তুই কি করলি, তোর ভাগের রসগোল্লাগুলো তো খেলিই আবার লোভ সামলাতে না পেরে ভাইয়েরগুলোও শেষ করে দিলি। একটা করে খাচ্ছিস আর বলছিস – না এটাই লাস্ট, আর খাবো না। এই করতে করতে দেখা গেলো রসগোল্লার ভাঁড় ফাঁকা। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো ? মা তোকে ভাইয়ের রসগোল্লাগুলো রাখতে বললো, তুই বেমালুম খেয়ে ফেললি- আর তোর মা এসে দুমদাম পিঠে কিল বসিয়ে দিলো কয়েকটা।’ হেসে ফেলেন মহীধরবাবু, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েরাও। তারপরেই গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘এ তো গেলো রক্ষক ভক্ষকের কথা, কিন্তু আমরা এই মানুষরা, আমরা অনেক বেশি কিছু, ভীষণ ক্ষতিকারক। আমরা হলাম একই সাথে ভক্ষক ও ধ্বংসক। শুধু গাছের মিষ্টি আম খেয়ে আমরা খুশি নই। সেই বিশাল আমগাছকে কেটে, পুড়িয়ে, জ্বালানি করে যে ভয়ংকর বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি করছি, তার দ্বারা আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের দিকে প্রতিদিন এগিয়ে নিয়ে চলেছি। আমাদের চারপাশে এরকম অনেক উদাহরণ পাবি।
এই পৃথিবীতে আমরা, এই মানুষ নামক জীবেরাই একই সাথে ভক্ষক ও নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসক।