অনেক দিন পরে দূর থেকে স্বপনের গান কানে ভেসে আসায় মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে গেলো মহীধরবাবুর। স্বপন যত কাছে আসছে ততোই গানের কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন মহীধরবাবু। আহা! কি গানই বেঁধেছে স্বপন।
হাসি কান্নায় দুঃখ সুখে
গান যে গাওয়ার নেই মানা।
এই দুনিয়াই আসা যাওয়া
দুয়ের ঠিকানা
কত সহজে, কত বড় সত্যটাই না বলেছে! লক্ষ লক্ষ মানুষ যুগ যুগ ধরে এই পৃথিবীর বুকে জন্মাচ্ছে আবার মারা যাচ্ছে। নদীর অবিরাম স্রোতের মতই সুখ, দুঃখ, হাসি কান্নাও অবিরত বয়ে চলেছে। এই নিয়মের এতটুকুও ব্যতিক্রম হয় না কোনো দিন। কারণ এই পৃথিবী যে প্রতিনিয়ত কোটি কোটি জীবের জন্মের আনন্দ আর মৃত্যুর বিচ্ছেদ সয়ে চলেছে এক অপরিসীম নির্বিকার সহনশীলতায়; অথচ এত যন্ত্রণা এত কষ্ট সহ্য করেও সেই পৃথিবী কিন্তু বিশ্ব চরাচরে পাহাড়, নদী, ঝর্না, সমুদ্র, জঙ্গল, ফুল আর পাখির কলতানে তার মুখের স্মিত হাসি ছড়িয়ে দিয়েছে। এই পৃথিবীর বুকেই সর্বজীবের জন্ম আর পৃথিবীতেই শেষ, অর্থাৎ এই সমগ্র প্রক্রিয়ার একমাত্র ধারক বাহক হয়েও পৃথিবী অপার মাতৃস্নেহে আমাদের প্রতি তার সব দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে চলেছে। তার থেকে শিক্ষা নিয়েই আমাদেরও কর্তব্য পালন করতে হবে, আর সেই দায়িত্ব ও কর্তব্য হল এই পৃথিবী মাকে ভালবাসা।
আসলে তাঁর খুব পছন্দের মানুষদের মধ্যে স্বপনও একজন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে স্বপন ডাক দিতেই মহীধরবাবু সাদরে ডেকে নিলেন ঘরে। বললেন, ‘আরে এসো এসো, তুমি আবার বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকা ডাকি করছ কেন ?’ স্বপন দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে, ‘না স্যার, আপনি কত ব্যাস্ত থাকেন, আপনাকে বিরক্ত করতে লজ্জা লাগে।’
‘আরে না না, কী যে বলো, তুমি এলেই আমার বড় আনন্দ হয়। কত জায়গায় যাও তুমি। কত মানুষের সাথে আলাপ হয়। তোমার কাছ থেকে কত কী জানা যায়।’
‘হ্যাঁ স্যার, এবারে অনেক জায়গায় ঘুরেছি, ধরিত্রী মায়ের নামে গান বেঁধে শুনিয়েছি লোককে আর বলেছি-’ বাধা দিয়ে মহীধরবাবু বলেন, ‘কী বললে মানুষকে স্বপন ?’
‘স্যার আমি মানুষকে বলেছি সবাই অনেক বড় কাজ করো,অনেক জ্ঞানী,অনেক অর্থবান হও কিন্তু তার আগে একটা খুব সহজ কাজ করো দেখি। আমি যখন কাজটা বলবো দেখবে তার থেকে সহজ কাজ আর হয় না। এর জন্য কোন কষ্ট করতে হবে না, উপোস করে থাকতে হবে না,প্রচন্ড গরমে বা ভীষণ শীতে কষ্ট পেতে হবে না - এ কাজ সবাই করতে পারে। সেটা হল এই পৃথিবী, যেখানে আমরা জন্মেছি, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যার বুকের উপর দাঁড়িয়ে সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, প্রেম-ভালোবাসা উপভোগ করেছি, দু’চোখ ভরে দেখছি এত আলো এত ফুল, এত পাখি আরও কতো কতো সুন্দর জিনিস, সেই পৃথিবীকে ভালোবাসাই আমি বলছি সবচেয়ে সহজ কাজ। এর জন্যে শুধু লাগবে একটু যত্ন আর পৃথিবীকে আমাদের সবার একান্ত আপন বলে ভাবলেই হবে। তাহলেই দেখবে তোমাদের অন্য সব কাজ কত সহজে হবে, আর সব কাজেই তোমরা এগিয়ে যাবে, সফল হবে আমাদের পৃথিবী মাকে ভালোবাসায়। আমি ঠিক বলছি না স্যার ?’
শিশুর মতো খুশি হয়ে ওঠেন মহীধরবাবু, বলেন, ‘ঠিক, একেবারে ঠিক বলেছ স্বপন। তাহলে এই আনন্দে একটু চা হয়ে যাক, কী বলো। ঐ কোণে দেখ সব আছে। ভাল কথা, তুমি চা করতে পার তো ?
‘হ্যাঁ স্যার, পারি।’ তাড়াতাড়ি করে ঘরের কোনের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে স্বপন বলে, ‘কিন্তু স্যার, আপনি কি আমার হাতের তৈরী চা খাবেন?’ অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে স্বপনের দিকে তাকিয়ে মহীধরবাবু বলেন, ‘সে কী! এই এত বয়েস পর্যন্ত তো হাতে তৈরী চা-ই খেয়ে এলাম। তুমি কী মেশিনে চা বানাও নাকি।’ মহীধরবাবুর কথা শুনে হেসে ফেলে স্বপন, চায়ের সরঞ্জাম খুঁজে নিয়ে চা করতে শুরু করে। মহীধরবাবু বলে চলেন, ‘আচ্ছা স্বপন এ কথা কোনদিনও ভেবে দেখেছ, তুমি, আমি, এই আমরা যারা সুস্থভাবে এই পৃথিবীতে জন্মেছি, তারা পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ-সমস্তটুকু আমাদের সমস্ত চেতনা দিয়ে অনুভব করি, আমাদের উপর সৃষ্টিকর্তার কতখানি আশীর্বাদ আছে! পৃথিবীতে, যাদের কেউ চোখে দেখতে পায় না, কানে শুনতে পায় না, আবার অনেকে ভালভাবে হাঁটাচলাও করতে পারে না, তাদের জীবন কতখানি যন্ত্রণাময়, তা একবার ভাবো তো! অথচ সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের আর কষ্টের কথা কি জানো, আমরা যারা এই পৃথিবীর সৌন্দর্য, রূপ, লাবণ্য পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করি, তারাই এই পৃথিবীকে আঘাত করি, সম্পদ ধ্বংস করি; আমাদের সাথে সাথে পৃথিবীর কোটি কোটি অন্যজীবকেও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি, প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে।
কিছুদিন আগেই তো কেরলে একটি গর্ভবতী হাতিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। কথা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দেন মহীধরবাবু। তারপর বলেন, ‘আচ্ছা স্বপন, আমরা তো সবাই জানি মৃত্যু হল এই পৃথিবীর জীবজগতের চরম পরিণতি। আমরা, মানুষরাও তো তার ব্যতিক্রম নই। কিন্তু আমরা যখন চলে যাই এই পৃথিবী থেকে তখন কিন্তু অধিকাংশ মানুষই একটা জিনিস সঙ্গে নিয়ে যায়। কী বলো তো ?’
স্বপন অবাক হয়ে বলে, ‘সে কী স্যার! সব কিছুই তো ছেড়ে যেতে হয়। এমন কী পরনের কাপড়টা পর্যন্ত –’ বাধা দিয়ে মহীধরবাবু বলেন, ‘সেটা তো আমরা জানি, কিন্তু একটা জিনিস শেষ নিঃশ্বাস পড়া পর্যন্ত সঙ্গেই থেকে যায় বেশিরভাগ মানুষের, সেটা হল- হতাশা ।’
‘কেন স্যার, হতাশা কেন ?’
‘হতাশা এই কারণেই যে, পৃথিবীতে এতদিন থাকলাম কিন্তু এই পৃথিবীর মহিমাকেই তো উপলব্ধি করতে পারলাম না বা ভালবাসতে পারলাম না। অথচ সবকিছু শুধু নিয়েই গেছি। এই কষ্টটাই তাকে কুরে কুরে খায়।’ এতক্ষণ হাঁ করে স্বপন শুনছিল মহীধরবাবুর কথা, এবার বলে, ‘এমন করে কখন তো ভাবি নাই স্যার, আর কেউ বলেও নাই।’ একটু হাসেন মহীধরবাবু। তারপর জিজ্ঞাসা করেন, ‘আচ্ছা স্বপন, তুমি তো ঠাকুর দেবতা মানো ?’
‘মানি স্যার, কিন্তু সবাই যেমন করে মানে তেমনটি করে নয়। আমার কেন জানি মনে হয় স্যার, আমি যারে আমার দেবতা ভাবি, তিনি যেন আমার বড় আপন, যখন একটা সুন্দর ফুল দেখি, মনে হয় তিনি হাসছেন, একটা ছোট বাচ্ছাকে যখন দেখি, ধূলো মাটি মেখে খেলা করতে, মনে হয় এই তো তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন, আমাদের সব কাজে। আবার যখন সন্ধ্যাবেলা গাছের ডালে ডালে অনেক পাখির কিচিরমিচির শুনি তখন মনে হয় দেবতা যেন ডেকে বলছেন - ভালো থাকো তোমরা সবাই, সুখে থাকো, আনন্দে থাকো।’
ভারি খুশি হয়ে মহীধরবাবু বলেন, ‘এই তো, এই তো জীবনের সার সত্য তুমি বুঝে ফেলেছ স্বপন। একেই বলে পবিত্র ভালোবাসা। আর এই পবিত্র ভালোবাসাই হল এক স্বর্গীয় অনুভূতি যা আমরা এই পৃথিবীতেই লাভ করতে পারি, এই পৃথিবীর প্রতি আমাদের ভালবাসার দ্বারাই। এক বাঙ্গালি কবি বলেছেন - দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা। সেই দেবতাকে যেই নামে ডাকা হোক না কেন, কোন মঠ, মন্দির, গীর্জা, গুরুদোয়ারা অথবা মসজিদ-এ তিনি নেই। যে নামেই তাঁকে ডাকা হোক না কেন, তিনি ছড়িয়ে আছেন খোলা আকাশে, বাতাসে, মুক্ত চরাচরে, বিশ্ব প্রকৃতিতে। এই বিশ্ব প্রকৃতিকে অন্তর থেকে ভালোবাসতে পারলে তবেই তিনি হবেন আমাদের প্রিয়জন। আমাদের বন্ধু। আমরা যখন ছোট থাকি, যখন আমাদের বুদ্ধি পরিণত থাকে না, তখন আমরা বাবা-মায়ের কাছে আমাদের যা মনে আসে তাই চেয়ে বসি।
আমরা একবারও ভেবে দেখিনা যে আমরা যা চাইলাম, তা আদৌ বাবা-মায়ের পক্ষে দেওয়া সম্ভব কিনা। আসলে বাবা-মাকে তো আমরা আমাদের থেকে আলাদা কেউ মনে করি না। ভাবি আমাদেরই অতি প্রিয়, অতি আপনজন। আমাদের অল্টার ইগো। তাই আমাদের যা মনে আসে অকপটে দ্বিধাহীন ভাবে তাই চেয়ে বসি। ঠিক তেমনি ভাবেই যদি আমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে একথা বলতে পারি যে, অসীম করুণা তোমার আমাদের প্রতি, কারণ, এই অসামান্য সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করে তুমি আমাদের এখানে পাঠিয়েছ, বুদ্ধি ও ভালোমন্দের বিচারক্ষমতা নামক এক শ্রেষ্ঠতম বস্তু উপহার দিয়েছ যার বলেই আমরা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জীব। এত কিছু দিয়েছ বলেই তোমার কাছে আমাদের চাওয়ার মাত্রাও সীমাহীন, আর সেই সঙ্গে একটা ছোট্ট অভিমান ভরা প্রশ্ন তোমার কাছে, এতই যখন দিলে তখন দু’চোখ ভরে দেখার আর প্রাণ ভরে উপভোগের সুযোগ এত কম দিলে কেন ? আমাদের অমর করে দিলে না কেন ? যত অদ্ভুত আর হাস্যকরই শোনাক না কেন, আমাদের এই প্রার্থনা, এই আবদার - প্রকৃত অর্থে তিনিই আমাদের সবথেকে আপনজন, আমাদের আত্মার আত্মীয়; তাই এই আবেদনের মধ্যে দিয়েই তাঁর সঙ্গে তৈরী হবে এক নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আর একটা কথা আমরা কিছুতেই মনে রাখি না, আমরা তথাকথিত ধর্মের নামে নিজেদের অজস্র ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ করেছি, হানাহানি করে চলেছি, আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ বলে জাহির করছি। এই ধর্মের দ্বারা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আমাদের আলাদা করেন নি। তাঁর কাছে এই ভাগাভাগির কোন মূল্যই নেই। তাই যুগে যুগে, দেশে দেশে যখনই ধর্মের নামে দুই গোষ্ঠিতে শুরু হয় প্রাণঘাতী লড়াই, তখন হাজার হাজার মানুষকে তার প্রিয় জন্মভূমি, তার দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রাণ ভয়ে আশ্রয় নিতে হয় অন্য কোন দেশে - তখন যে ধর্ম নিয়ে এত বড়াই, এত লড়াই, সেই ধর্ম কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারে না, আশ্রয় দিতে পারে না; যে দেশের মাটিতে গিয়ে দাঁড়ায়, সেও এই পৃথিবীরই অংশ। তাকে আশ্রয় দেয়, প্রান বাঁচায় এই বিশ্বমাতা, এই ধরিত্রী অর্থাৎ আমাদের এই মাতৃভূমি যা কোন দেশের ক্ষুদ্র ভৌগলিক সীমানায় আবদ্ধ নয়। এ হল আমাদের বিশ্বমাতৃভূমি। তাই আমাদের সবটুকু আনুগত্য পৃথিবীর প্রতিই থাকা উচিত। আর আমাদের পবিত্র ভালবাসা অর্পণ করা উচিত এই পৃথিবীকেই। আর পৃথিবীকে ভালবাসাই হোক আমাদের পবিত্রতম ধর্ম। আরও একটা কথা কি জানো স্বপন, এই যে শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষগুলো যাদের কেঊ চোখে দেখতে পায় না, কেঊ কানে শুনতে পায় না, আবার অনেকে ভালোভাবে হাঁটাচলা করতেও পারে না, তাদের জীবন কতখানি যন্ত্রণাময় তা একবার ভাবো তো। এই পৃথিবীর পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ পায়নি যারা, তারা কিন্তু আরও একবার এই পৃথিবীতে আসার সুযোগ পাবে, পাবেই। এটাই আমার উপলব্ধি। ধরা গলায় স্বপন বলে, ‘আমি এই কথা মনে রাখবো স্যার’।
স্বপনের দিকে একবার তাকিয়ে জানালা দিয়ে তাঁর দৃষ্টি মেলে দেন সুদূরে।