।। একাদশ।।

    আজ ১৫ই আগষ্ট। স্বাধীনতা দিবস। সকাল থেকে স্কুলে আজ নানান বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। সচরাচর এই ধরনের কোন অনুষ্ঠানে মহীধরবাবু যেতে চান না। তার একমাত্র কারণ সভা সমিতি, কোলাহল, হৈ চৈ, অকারণ হাসি, নিন্দা, সমালোচনা এগুলো অত্যন্ত সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলেন তিনি। আসলে প্রতিমূহুর্তে তাঁর মধ্যে একটাই চিন্তা চলতে থাকে, এই যে এত আনন্দ অনুষ্ঠান, এত সভা সমিতি এসবের কি কোন মূল্য থাকবে যার বুকের উপর দাঁড়িয়ে এত উদ্যোগ আয়োজন, যদি সেই পৃথিবীই বাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে! এইসব ভাবতে ভাবতে হাঁটা দেন স্কুলের দিকে কারণ হেডস্যার সম্বিতবাবু বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন তাঁকে আজকে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে। কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন যে পরিচালন সমিতির সব সদস্যই উপস্থিত থাকবেন এই অনুষ্ঠানে এবং তারা চান স্কুলের সব শিক্ষক এবং অ-শিক্ষক কর্মচারী, সবাই যেন স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। যদিও পরিচালন সমিতির এই ধরনের নির্দেশের খুব একটা গুরুত্ব নেই মহীধরবাবুর কাছে। কিন্তু সম্বিতবাবু মানুষটিকে খুব পছন্দ করেন মহীধরবাবু। তাঁর কোন অনুরোধ এড়াতে পারেন না।
    এক এক করে অনেকের বক্তব্যের পর হেডস্যার ঘোষণা করলেন মহীধরবাবুর নাম। বিব্রত বোধ করেন মহীধরবাবু, কারণ গতানুগতিক কিছু বাঁধাধরা কথা তাঁর মুখ থেকে বেরোয় না, এই নিয়ে হয়তো শুরু হবে অনেক সমস্যা আর তার জের সামলাতে হবে সম্বিতবাবুকেই। এই সব ভাবতে ভাবতেই উঠে দাঁড়ান মহীধরবাবু। বলতে শুরু করেন, ‘আজ স্বাধীনতা দিবস, খুব আনন্দের দিন। খুব আনন্দ করে সারা দেশে স্বাধীনতা দিবস পালিত হচ্ছে। ভালো লাগারই কথা, ভালো লাগছেও কিন্তু সেই সঙ্গে আর একটা কথাও মনে হচ্ছে, সারা বছর এই একটা দিনই এত গুরুত্ব দিয়ে উদযাপিত হয় কেন ? আর বছরের বাকি সময়টাতে আমাদের আচরণে, ব্যবহারে, কাজে অথবা প্রতিবাদে এই স্বাধীন মনোভাব প্রতিফলিত হয় কি ? পারি কি আমরা অকুণ্ঠ সাবলীল ভাবে আমাদের কোন ব্যক্তিগত মতামতকে তুলে ধরতে সব সময় ? পারি না। তবে কি আমরা সত্যি সত্যি স্বাধীন হইনি ? স্বাধীন হওয়ার ভান করছি? সারা পৃথিবী জুড়ে টুকরো টুকরো করেছি বিশাল এই ভূখন্ডকে, আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলছি, দেখো, এই আমাদের স্বাধীন দেশ। আমি এই স্বাধীন দেশের নাগরিক। ছোট ছোট টুকরো করছি এই পৃথিবীর মাটিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে, পাঁচিল তুলে, এপারে আমরা স্বাধীন আর ওপারে ওরা - কী অদ্ভুত ব্যাপার! আমরা কথায় কথায় বলি উপরওয়ালার দান, উপরওয়ালার দয়া - কিন্তু আমরা কি সত্যি সত্যি মনে রাখি উপরওয়ালা অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার দয়ার কথা, দানের কথা ? তিনি যখন দয়া করে এই বিশাল পৃথিবী আমাদের বসবাসের জন্য দান করেছিলেন তখন কি তিনি জমি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, এ এখানে থাকবে ও সেখানে থাকবে ? তিনি কি ভাবতে পেরেছিলেন মানুষ পাসপোর্ট - ভিসা এবং আরও কত জটিলতার সৃষ্টি করবে তাঁর অতি প্রিয় এই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাওয়ার জন্যে? কই অন্য প্রাণীদের তো দেশভাগ আর বিভেদ আলাদা করতে পারেনি। পরিযায়ী পাখিরা ভয়ংকর শীত থেকে বাঁচতে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে চলে আসে অন্য দেশে, কই তাদের তো পথ ভুল হয় না, ঠিকানার দরকার হয় না, আবার নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক তারা ফিরে যায় যেখান থেকে এসেছিল। তাদের এই আচরণ দেখেও সৃষ্টিকর্তা কি চান, তা আমাদের মাথায় আসে না ? এইভাবেই তো তিনি আমাদের বার্তা দেন। যখনই আমরা কোনো বিপদে পড়ি তখন বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি। কিন্তু তিনি তো সরাসরি আমাদের কাছে আসেন না, কখনো প্রকৃতির মাধ্যমে আবার কখনো কোনো মানুষের দ্বারাই তিনি আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু - এই কথাটা আমরা যখন তখন বলে থাকি, কিন্তু একবারও ভেবে দেখেছি কি, যে পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমাদের সব রমরমা সেই পৃথিবীর সব সম্পদ লুঠ আর শোষণের চরম লোভই আমাদের এনে দাঁড় করিয়েছে একেবারে খাদের কিনারায়! পৃথিবী একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, আর পারছে না সে এই জীবজগতকে ধারণ করতে। কিন্তু সমগ্র জীবজগতের ধ্বংসের একমাত্র কারণ এই মানুষ নামক জীব। অন্যদের কিন্তু কোন দোষ নেই! এ পাপ, বড় চরম পাপ, আর সেই পাপেই শেষ হবো আমরা।’
    এই পর্যন্ত বলে একটু থামেন মহীধরবাবু, চারিদিকে তাকিয়ে দেখেন, সবাই মন্ত্র মুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। আবার শুরু করেন মহীধরবাবু- ‘এই আত্মধংসের হাত থেকে বাঁচতে আমাদের সবার আগে খুঁজে পেতে হবে বিবেক ও বিবেচনা সম্পন্ন মানুষ। তা পাবো কী করে ? পেতে হবে অবস্থার তারতম্যের ভিত্তিতে তার ব্যবহার ও আচরণের দ্বারা। অর্থাৎ একটি মানুষ যদি দুঃস্থ ও অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকে, তখন তার ব্যবহার ও আচরণ যেমন আছে, যদি তার সামাজিক অবস্থান - অর্থ, প্রভাব প্রতিপত্তি, নাম, যশ অর্থাৎ সবদিক দিয়েই যদি পরিবর্তিত হয়, তাহলে তখনও তার আচরণ আগের মতো আছে কিনা- যদি তাই থাকে তাহলে বুঝতে হবে তার বিবেক ও বিবেচনা দুই-ই আছে। তখন সে বুঝবে, নিজেদের বাঁচার জন্যেই এই পৃথিবীকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে হবে এই মুহূর্তে। আচ্ছা, এই যে পৃথিবী নিয়ে এত কথা বললাম, কেউ দুটো শব্দের মধ্যে বলতে পারো পৃথিবীটা কী ?’
    সবাই চুপ করে আছে দেখে মহীধরবাবু বলেন, এই পৃথিবী “দানের জমি”। এটা আমরা পেয়েছি শর্তহীন ভাবে। কিন্তু একটা অনুচ্চারিত শর্ত এখানে আছে, সেটা হল সুশৃঙ্খলভাবে ভালবাসা ও যত্ন করার দায়িত্বও কিন্তু আমাদেরই। আর আমরা তো কেউ এক ধর্মের, কেউ অন্য ধর্মের- আমরা বিভিন্ন ধর্মের রীতি অনুযায়ী কেউ ভগবান, কেউ আল্লা, আবার কেউ গড কে ডাকি। আমাদের বিপদে তাঁর কাছে উদ্ধার পাওয়ার আর্জি জানাই। প্রার্থনা করি, আমরা যেন আমাদের পরিবারকে নিয়ে সুখী থাকি। কিন্তু তবু আমরা সুখী থাকতে পারি না। কেন পারি না ? পারি না, কারণ, আমরা নিজ নিজ ধর্মের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করি সেই মহান স্রষ্টাকে, একবারও ভাবিনা যে তার পরম প্রিয় সৃষ্টি এই পৃথিবীর আকাশ, বাতাস, পাহাড়, নদী, অরণ্যেই বিকশিত তাঁর মহিমা। অল্পে যে সন্তুষ্ট হতে পারে সেই সুখী থাকে। কিন্তু আরও চাই আরও চাই হয়ে গেছে একমাত্র ধর্ম। সর্বগ্রাসী লোভই চরম অসুখী করে তুলেছে মানুষকে। তাই কোন ধর্ম আজ সুখী রাখতে পারছে না মানুষকে। কারণ, সুখ কোন বাহ্যিক বস্তু নয়। তা একান্ত ভাবেই অন্তরের অনুভূতি। আর একটা কথা বলেই আমি শেষ করব বক্তব্য, সেটা হল - এই নতুন প্রজন্মের কাছে অর্থাৎ তোমাদের কাছে আমি একটা জিনিস চাইব। সেটা হল ধৈৰ্য্য। এই ধৈর্য্যের অভাবে আজকের ভোগবাদের পৃথিবীকে কেমন একটা একগুঁয়ে জেদী মনোভাব গ্রাস করছে। খালি মনে হচ্ছে আমি যেটা চাই, সেটা পাবো না কেন ? এই চাহিদা, এই না পাওয়ার হতাশায় এই তরুণ প্রজন্ম ভীষণ ভাবে অধৈৰ্য্য হয়ে পড়েছে, আর তার ফলে যে সাফল্য কখনও আসতে পারত, সেই সাফল্য তাদের সঙ্গী হচ্ছে না কারণ আমরা সবাই এটা জানি যে জীবনে যেকোনো বিষয়ে পরম সাফল্য এসে ধরা দেয়, চরম ধৈর্য্যের ফলেই। তাই আমার অনুরোধ তোমাদের সবার কাছে, একটু ধৈৰ্য্যশীল হলে পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক না কেন সব বাধা কেটে যাবে, সাফল্য এসে ধরা দেবেই।’
এই পর্যন্ত বলে কপালের ঘাম মুছে চেয়ারে বসে পড়েন মহীধরবাবু। কয়েক মহূর্ত পিন পতনের শব্দ পাওয়ার মতই নিস্তব্ধতা। তারপরেই সম্বিতবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে ওঠেন আর সেই সঙ্গে তুমুল হাততালি দিয়ে ওঠে উপস্থিত সবাই।