।। নবম।।

    মহীধরবাবুর আজকের ভূগোলের ক্লাস আবার বসেছে খোলা আকাশের তলায়, মুক্ত প্রকৃতিতে, নদীর চরে। নদীর মাঝখানে জল সরে গিয়ে বেশ কয়েকটি চর জেগে উঠেছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা এই চরগুলো বড় প্রিয় মহীধরবাবুর। সময় সুযোগ পেলেই এইরকম কোনো চরে এসে বসে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। আর সত্যি কথা বলতে সময়ের অভাব তাঁর হয় না। কারণ তিনি উৎসাহ নিয়ে যে কয়েক ঘন্টা স্কুল করেন, তার বাইরে সংসারের বিন্দুমাত্র কাজ তাঁর দ্বারা হয় না। এই নিয়ে প্রচুর লড়াই, ঝগড়া হয়েছে ধরিত্রীর সাথে তাঁর।কিন্তু ধরিত্রী হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন এই ঝগড়াঝাটির ফলে তার শরীর, মন, সময় নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ হয় না। আসলে এই সবুজ চর মহীধরবাবুকে দেয় এক আশ্চর্য অনুভূতি। ঘাসের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন, নীচে এই মখমলের মত ঘাস, তার উপরে আকাশ দেখে তার মনে হয় এই এক টুকরো নদীর চরই যেন সমগ্র পৃথিবী। আরামে চোখ বুঝে আসে। মনে মনে ভাবেন, এই কচি সবুজ নরম ঘাসের মতই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। সারা পৃথিবী ব্যাপী ধ্বনিত হচ্ছে একটাই মন্ত্র, সে মন্ত্র পৃথিবীকে ভালোবাসার মন্ত্র। সেখানে দেশ ভাগের কোন সীমানা নেই, নেই কোন কাঁটা তারের বেড়া আর ভিসা-পাসপোর্টের জটিলতা। সবুজে সবুজে ভরে আছে সারা পৃথিবী। আঃ কবে সেই দিনটা আসবে! এসব কথা ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন মহীধরবাবু, ঠিক সেই সময়ে একটা কচি গলা ডেকে ওঠে। চমকে উঠে বসেন মহীধরবাবু। দেখেন তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃস্পাপ সরল হাসি হাসছে একটি ছোট্ট মেয়ে। একটু তাকিয়ে বুঝলেন, এ তাঁরই ছাত্রী সুস্মিতা। হাসলেন মহীধরবাবু, বললেন, ‘বল কী বলবি।’
    ‘স্যার, আপনি যে আগের দিন বলেছিলেন আমরা কোন গ্রামে থাকি, কোন জেলা, কোন থানা, কোন রাজ্যে – সব মুখস্থ করে আসতে, আমি সব মুখস্ত করে এসেছি।’
    ‘বাঃ, বাঃ, বল তো দেখি।’
    ‘গ্রামের নাম শিমুলতলা, থানা-শ্যামপুর, জেলা - দক্ষিণ ২৪ পরগণা, রাজ্যের নাম-পশ্চিমবঙ্গ, আর দেশের নাম ভারতবর্ষ।’
    ‘বাঃ দারুণ। খুব সুন্দর মুখস্ত করেছিস তো’ হেসে বললেন মহীধরবাবু। আরও কয়েকজন হাত তোলে, ‘স্যার আমরাও মুখস্ত করেছি।’
    ‘আমি জানি তো তোরা মুখস্ত করবি, তোরা সবাই তো খুব ভালো ছেলে মেয়ে। তোদের বলার পর, আমিও কয়েকদিন ধরে এটা মুখস্ত করার চেষ্টা করে চলেছি, কিন্তু হচ্ছে না কেন বল তো ? খালি ভুলে যাচ্ছি। থানার নাম মনে থাকলে জেলার নাম ভুলে যাচ্ছি আর কোন রাজ্যে যে থাকি সেটা তো  মনেই করতে পারছি না।’
    ছেলে মেয়েরা হি-হি করে হেসে ওঠে তাদের মহীস্যারের কথা শুনে। ওদের সঙ্গে হেসে ফেলেন মহীধরবাবুও। তারপর হাসি থামিয়ে বলেন, ‘কিন্তু একটা কথা খুব ভালো মুখস্ত হয়েছে আমার। একদম তোদের মতই। বলব ?’
    ‘বলুন স্যার, বলুন,’ সমবেত আওয়াজ ওঠে।
    মহীধরবাবু বললেন, ‘আমার কয়েকদিন ধরে মনে হচ্ছে আমাদের গ্রামের নাম-পৃথিবী, থানা -পৃথিবী, জেলা পৃথিবী, রাজ্যের নাম -পৃথিবী, আর এই যে দেশটায় আমরা থাকি, সেই দেশটাও পৃথিবী।’
    অবাক গলায় রাতুল বলে, ‘স্যার, রাজ্য, থানা, জেলা সবই এক, সবই পৃথিবী!’ হেসে মাথা নাড়েন মহীধরবাবু। শিপ্রা বলে, ‘কিন্তু স্যার, চিঠি পত্র সব আসবে কোন ঠিকানায়, আর যদি কেউ হারিয়ে যায়, তাহলে বাড়িতে ফিরবে কি করে ?’
    ‘কেন রে?’ হেসে বলেন মহীধরবাবু, তখন তো সবার ঠিকানাই এই পৃথিবী, কারোর তো কোন আলাদা ঠিকানা থাকবে না। কেউ যদি হারিয়ে যায়, তাহলে সে এই পৃথিবীতেই হারাবে, আবার নিজে নিজেই ফিরে আসবে। তখন তো ভিসা থাকবে না, পাসপোর্ট থাকবে না, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে গেলে কারোর কোনো অনুমতি লাগবে না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলব - আমরা ভারতবাসী নই, আমরা আমেরিকাবাসী নই, আমরা ইংল্যান্ডবাসী নই - আমরা বিশ্ববাসী, বিশ্ব নাগরিক, এই পৃথিবীর সন্তান আমরা, তাই আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা পৃথিবীবাসী। কিরে খুব মজা হবে না?’
    ‘হ্যাঁ স্যার, ঠিক বলেছেন’ চেঁচিয়ে ওঠে সবাই।
    ‘আচ্ছা স্যার,’ পলাশ বলে, ‘সব জায়গায় দেখেছি লেখা - একটি গাছ একটি প্রাণ, গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান। এর মানে কি স্যার ? মানুষের শরীর খারাপ হলে আর ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে যেতে হবে না ? বাড়িতে একটা গাছ পুঁতে দিলেই হবে ?’ হো-হো করে হেসে ওঠেন মহীধরবাবু, তারপর বলেন, ‘না রে, ব্যাপারটা সে রকম নয়। আমরা যখন অসুস্থ হই, তখন তো ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, ওষুধ খেতে হয়, তখন রুগী সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের যত রোগ আছে, তার মধ্যে অনেকগুলো রোগের কারণ হল দূষিত পরিবেশ। আর পরিবেশ দূষিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা। এর ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষ পৃথিবীতে আসার অনেক অনেক আগে এসেছে গাছ। তাই গাছ মানুষের অগ্রজ। অনেকদিন আগেই প্রমাণিত হয়ে গেছে গাছ সজীব। প্রাণ আছে। তাই গাছও জন্মায়, বেড়ে ওঠে আবার মরেও যায়। আমরা যখন তখন আমাদের সুবিধার্থে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলি। গাছ কথা বলতে পারে না বলেই কি এই নিষ্ঠুর হত্যা। কেউ যদি একটা মানুষকে খুন করে, তার জেল হয়, ফাঁসি হয়, তাহলে এত গাছ কেটে পরিবেশ ধ্বংস করার জন্যে, মানুষকে ভয়ংকর বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার জন্যে ঐ লোকগুলোর কতবার ফাঁসি, কত বছর জেল হওয়া উচিত বল তো তোরা ? গাছ আর মানুষ হল পরস্পরের বন্ধু। শুধু তাই নয়, গাছ হল মানুষের পরম উপকারি বন্ধু। সেই বন্ধুকে ধ্বংস করা কেমন মনুষ্যত্বের কাজ? পরিবেশ বাঁচাতে, নিজেদের বাঁচাতে গাছ লাগাতে হবে, গাছ বাঁচাতে হবে, গাছের রক্ষণা বেক্ষণ করতে হবে, তবেই একটা সুস্থ সবল গাছ অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচাবে। এই কথাটা আজ সবাইকেই বুঝতে হবে। মানুষ যে বিষয়ে যত সফলই হোক না কেন, সব পরীক্ষাতে একশোয় একশো পাক না কেন, তা একেবারেই বৃথা হয়ে যাবে যদি মানুষ এটা না বোঝে যে পরিবেশ দূষণমুক্ত, নির্মল না হলে, অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত না হলে, এই পৃথিবীর পরিবেশ নির্মল না থাকলে কোন সাফল্যেরই কোন মূল্য থাকবে না। তাই আমাদের সবার আগে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে যে, সবার আগে, সবার উপরে এই পৃথিবীর সুরক্ষা, আর তার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অস্তিত্ব। এই পৃথিবী বাঁচানোর পরীক্ষায় যদি আমরা সফল হই, তবেই আমাদের সাফল্য সম্পূর্ণ হবে। না হলে নয়।’