।। অষ্টম।।

    আজ স্কুলে সারাদিন কেমন একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে কেটে গেল মহীধরবাবুর। আজকাল বেশির ভাগ রাতই কাটে নিদ্রাহীন ভাবে। গতকাল রাতেও তার অন্যথা হয়নি। রাত চারটে নাগাদ যখন ঘুমোতে গেলেন, তখন অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলেন মহীধরবাবু। দেখলেন অচেনা অদ্ভুত একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন তিনি আর তার সঙ্গে স্বপন বাউল। তিনি দেখলেন, যে রাস্তা দিয়ে তিনি হাঁটছেন সেই রাস্তা এবং সেখান থেকে যত দূর চোখ যায় চারিদিকে শুধু ধূ-ধূ করছে বালি। কোথাও সবুজের কোন চিহ্ন নেই। প্রাণের আভাস মাত্র নেই কোনোখানে। চারিদিকে হিমশীতল কঠিন নীরবতা। দু’জনে নিঃশব্দে হেঁটে চলেছেন। কারোর মুখে কোন কথা নেই। এই ভাবে অনেকটা রাস্তা হেঁটে যাওয়ার পর হঠাৎই এক সময় স্বপন তাঁর হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘ঐ দেখুন স্যার, দেখুন।’
    যে দিকে স্বপন ইশারা করছে সেই দিকে তাকিয়ে মহীধরবাবু দেখেন একটু দূরে রাস্তার দুপাশে বিশাল বিশাল গাছ। কিন্তু সবকটা গাছই বাজপড়ে ঝলসে যাওয়ার মত একেবারে ন্যাড়া। শুধু গাছের ডালে ডালে অজস্র কী ঝুলে আছে ওগুলো ! বাদুড় নাকি! দূর থেকে ঠিক বোধগম্য হয়না মহীধর বাবুর। স্বপনের হাত ধরে একটু জোরে হেঁটে সেই বিশাল গাছগুলোর কাছে আসতেই হঠাৎ মনে হয় তাঁর বুকে যেন কেউ প্রচন্ড জোরে হাতুড়ি পিটছে। মাথাটা কিছুতেই স্থির রাখতে পারছেন না। অনেক দূর থেকে যেন স্বপনের ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভয়ার্ত গলা ভেসে আসে - ‘স্যার, এগুলো তো, এগুলো তো-’
    এগুলো যে কী এতক্ষণে নিজের চোখেই দেখতে পেয়েছেন মহীধরবাবু। ডালে ডালে ঝুলে আছে অজস্র ছোট্ট ছোট্ট শিশুর মৃতদেহ। বিস্ফারিত চোখে দেখতে থাকেন মহীধরবাবু। ধীরে ধীরে কখন যেন শরীর শিথিল হয়ে মাটিতে, না বালির ওপর পড়ে যান মহীধরবাবু; কানে বাজে স্বপনের কণ্ঠস্বর, ‘স্যার, স্যার কী হল আপনার?’
    ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসেন মহীধরবাবু। ভীষন হাঁপাচ্ছেন। সারা গা ঘামে ভিজে একেবারে চ্যাপচ্যাপে হয়ে গেছে। শক্ত হয়ে গেছে সারা শরীর। জলের গ্লাস হাতে তোলার মত শক্তিও অবশিষ্ট নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সাড়ে সাতটা বাজে। হঠাৎ একটা বুকফাটা আওয়াজে একেবারে চমকে উঠলেন। কেউ যেন চিৎকার করে কাঁদছে। কে কাঁদছে, কোথায়, কেন? মুহুর্তে সব জড়তা, সব শিথিলতা কেটে যায় মহীধরবাবুর। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েন। দেখেন, বাইরের দরজা খুলে বেরতে যাচ্ছে ধরিত্রী। সচরাচর মহীধরবাবু এড়িয়েই চলেন ধরিত্রীকে। কথাবার্তা প্রায় নেই বললেই চলে। আপন আপন কক্ষ পথে ঘুরে চলা দু’টো গ্রহের মতই এই সংসারে ঘুরে চলেছেন তাঁরা। কিন্তু আজকে এই রকম একটা পরিস্থিতিতে ধরিত্রীকে জিজ্ঞাসা না করে পারলেন না চিৎকারটা কিসের, কে কাঁদছে? কোন উত্তর না দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন ধরিত্রী। পেছনে পেছনে মহীধরবাবুও। বাড়ির একটু দূরেই গোকুলের বাড়ি। গোকুল দাস, রাজমিস্ত্রির কাজ করে। চীৎকার আর কান্নাকাটির আওয়াজ আসছে ওদের বাড়ি থেকেই! ধরিত্রীর পেছনে পেছনে গোকুলদের উঠোনে এসে দাঁড়ানোর পরে নিজের চোখে যা দেখলেন, আর নিজের কানে যা শুনলেন, তাতে সমস্ত চেতনা অসাড় হয়ে গেলো মহীধর বাবুর। ধপ করে বসে পড়েন উঠোনের একপাশে...
    উঠোনের মাঝখানে সাদা কাপড়ে মোড়া একটা ছোট্ট শিশুর শরীর শোয়ানো আছে। একদিকে মাথা চাপড়ে কাঁদছে গোকুল আর একদিকে গোকুলের মাকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছে গোকুলের বউ। বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে। কিন্তু এটা কি করে হল ? ভোর বেলাতেই ঐ রকম একটা স্বপ্ন দেখলেন, আর তারপরেই এই রকম একটা ঘটনা! কেন ঘটল এমন একটা ঘটনা ? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে, বড়জোর মাস ছয়-আটেকের একটা বাচ্চা। এই বয়সেই পৃথিবীতে থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে গেল ওর! কোনো অপরাধ, ভাল-মন্দ কোনো কাজ করার মত সুযোগই তো আসেনি ওর জীবনে। তাহলে কেন এই মর্মান্তিক পরিনতি ?
    এই অবস্থার মধ্যে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না মহীধরবাবু। বেরিয়ে আসেন গোকুলদের বাড়ি থেকে। মনের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে তাঁর। শুধু মনে হচ্ছে বারবার কোন পাপে আর কার পাপে চলে গেল ঐ নিঃস্পাপ বাচ্চাটা। কেনই বা সে এলো পৃথিবীতে এত অল্প সময়ের জন্য ? ভাবতে ভাবতে কোন রকমে নিজের ঘরে এসে চেয়ারে বসে পড়েন। হঠাৎ মাথার মধ্যে দিয়ে যেন একটা বিদ্যুতের তরঙ্গ বয়ে যায় মহীধরবাবুর। দু’হাতে মাথা চেপে ধরেন।
    ...একটু একটু করে যেন চোখের সামনে থেকে একটা কালো পর্দা সরে যায় মহীধরবাবুর। স্বপ্নে দেখা দৃশ্যটা আবার ভেসে আসে মহীধরবাবুর সামনে। সারা শরীর কেঁপে ওঠে। ধীরে ধীরে এটা তাঁর মনে হতে থাকে যে এটা নিছকই কোন স্বপ্ন ছিল না। কোন এক সর্বশক্তিমানের নির্দেশ ছিল ওই স্বপ্নে। তিনি মহীধরবাবুকে ওই স্বপ্নের মাধ্যমে অনেক কিছু বোঝাতে চেয়েছেন। ঐ শিশুর অকাল মৃত্যুর কারণটা যেন এবার একটু একটু করে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে মহীধরবাবুর কাছে। বুঝতে পারছেন ঐ শিশুটির মৃত্যুর জন্য দায়ী সে নয়। একেবারেই নয়। দায়ী, তার আগে পৃথিবীতে আসা মানুষগুলো। যাদের ভয়ংকর লোভ আর চুড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এই পৃথিবীকে মারাত্মক ভাবে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। এই পৃথিবীটা, যা না থাকলে, ধ্বংস হয়ে গেলে, এই জীবজগতের আমরাই সেরা বলে প্রতিনিয়ত ঢাক পেটাতে থাকা এই যে অগণিত মানুষ, তাদের অস্তিত্বটুকুও থাকবে না - এত মৃত্যু, এত ধ্বংস, এত হত্যা, এত বিপর্যয় – তবুও তো হুঁস হয় না স্বার্থের পাঁকে আকণ্ঠ ডুবে থাকা মানুষের ; কিন্তু এই একটা শিশুর মৃত্যু একেবারে সিনেমার মতো পর পর সমস্ত দৃশ্যকে মহীধরবাবুর চোখের সামনে তুলে ধরল। তিনি বারবার বোঝাতে চেয়েছেন সবাইকে যে, আমাদের আকাশচুম্বি লোভ আর অতি উগ্র চাওয়ার ইচ্ছেই আমাদের অসুখী করে রেখেছে। চাওয়াও যেমন সীমাহীন হয়ে উঠেছে, তেমনি চরম অসুখীও হয়ে উঠেছে মানুষ। কিছুতেই আর তৃপ্তি নেই,সুখ নেই। অথচ নিজেকে সুখী করার ও অন্যকে সুখী করার একমাত্র উপায় হোল নিজের চাহিদা ও আকাঙ্খা কম করা। সবার আগে এই ভাবনাটা নিজের মধ্যে সঞ্চারিত হতে হবে যে, টাকা পয়সা বড় নয়, কিছুতেই নয়; কখনো হতে পারে না! কারণ টাকা পয়সা যা কিছু উপার্জন করা তা তো উপার্জিত হয়,এই পৃথিবী থেকেই আবার তা নষ্টও হয়ে যায় এই পৃথিবীতেই। একটা মানুষ যেমন সারাজীবন একই ভাবে অর্থ রোজগার করে যেতে পারে না, ঠিক তেমনি ভাবেই কোন অভাবী, দুঃস্থ মানুষকে সারাজীবন ধরে কেউ অর্থ সাহায্য করে যেতে পারে না। যাঁদের মনীষি বলি, প্রাতঃস্মরণীয় বলে যাঁদের দেখানো পথ আমরা অনুসরণ করি, তাঁরা যদি শুধুই দান করে যেতেন অর্থ, সম্পত্তি ইত্যাদি, তাহলে সেই দান করার ক্ষমতাও তাদের একদিন শেষ হত, আর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সেই দানের কথাও ভুলে যেত। কিন্তু যীশুখ্রীষ্ট, হজরত মহম্মদ অথবা গৌতম বুদ্ধ এঁরা মানুষকে দিয়ে গেছেন তাঁদের সাধনালব্ধ জ্ঞান ও মহামূল্যবান উপদেশ। সেই জ্ঞান ও উপদেশ সারা বিশ্বে অগণিত মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, পাথেয় হয়েছে তাদের চলার পথে। তাঁরা যদি অর্থ সম্পদ দান করে পৃথিবীর মানুষকে প্রভাবিত ও তাঁদের মত অনুসরণকারী হিসাবে দেখতে চাইতেন, সেক্ষেত্রে কিছু মানুষকে হয়ত সাময়িক ভাবে সঙ্গে পেতেন, কিন্তু যুগ যুগ ধরে এই যে অসংখ্য মানুষ তাঁদের জীবন-দর্শনকে গ্রহণ করেছেন, তাঁদের মত ও পথকে অনুসরণ করেছেন, তা কিছুতেই ঘটত না।
    সঠিক ও সত্য ভাবনার মূল্য অনেক অনেক বেশি। প্রকৃত সত্য, কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার দ্বারা অর্জিত জ্ঞানগর্ভ ভাবনাই পৃথিবীতে প্রকৃত অর্থে মূল্যবান। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে ক্রমশ ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে থাকেন। ভাবতে থাকেন, এই যে সৌরজগতের এত এত গ্রহ রয়েছে, যারা নাকি আকারে ও আয়তনে এই পৃথিবী নামক গ্রহের থেকে অনেক অনেক বেশি বড়, সেই সব গ্রহে পাড়ি দেওয়ার জন্যে, সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা তা জানার জন্যে এই পৃথিবীর প্রচুর দেশ যুগ যুগ ধরে অজস্র বৈজ্ঞানিকের মেধা, শ্রম, সময়, অকাতরে অর্থ ব্যয় করে চলেছে। অথচ যা জানা গেছে, আনুপাতিক হারে তা অতি সামান্য। এই এত সময় ও অর্থ ব্যয়ের কিছুটা অংশ যদি পৃথিবীর বিপুল সম্পদ সুষ্ঠভাবে ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণও সংরক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হতো, তাহলে এই পৃথিবীটাই হয়ে উঠতো বাস্তবের স্বর্গরাজ্য। কারণ এই পৃথিবী যে বড় শান্ত গ্রহ ও শান্তির গ্রহ। জীবজগতের চাহিদা মেটে এমন সমস্ত উপাদান সৃষ্টিকর্তা পরম যত্নে সাজিয়ে দিয়েছেন জলে, স্থলে, মাটির তলায়। জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের সাথে অন্য প্রানীদের তফাৎ একটাই, তারা এই পৃথিবী থেকে যা কিছু আহরণ করে, তা শুধুমাত্র তাদের জীবন ধারনের জন্যেই, তার বেশি একটুও নয়, কিন্তু পরম বুদ্ধিমান জীব মানুষ শুধুমাত্র লোভের বশবর্তী হয়ে হনন করে চলেছে পৃথিবীর পবিত্রতা ও শান্তি। শুধুমাত্র আত্মতৃপ্তি, ও সুখের জন্যে ধ্বংস করে চলেছে পৃথিবীর সব সম্পদ। প্রতিমুহূর্তে ডেকে আনছে সমগ্র জীবজগতের ধ্বংস। তাহলে কি সত্যি সত্যি সবথেকে বুদ্ধিমান জীব বলা যায় এই নির্বোধ আত্মধ্বংসকারী ও অদূর ভবিষ্যতের বিপদ সম্পর্কে চরম উদাসীন এই মানুষ নামক জীবগুলোকে ? কি করে বা বলা যেতে পারে সবার উপরে মানুষ সত্য ? কথায় বলে পাগলেও নিজের ভালো বোঝে। এই মানুষ জাতটা তার থেকেও অধম! না, তা হতে পারে না। চেয়ারে সোজা হয়ে বসেন মহীধরবাবু। চোখের দৃষ্টিতে স্থির সংকল্প। চোয়াল শক্ত।

জানালার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন –
সবার উপর পৃথিবী সত্য
কোন সংশয় নেই,
যত তাড়াতাড়ি বুঝবে মানুষ
লাভবান হবে সেই।