মহীধর বাবুর অদ্ভুত আবদার শুনে হাসবেন না কাঁদবেন, সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না সম্বিতবাবু। খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন মহীধরবাবুর দিকে, তারপর বললেন, ‘ইয়ে মানে মহীধরবাবু, আপনার শরীর ঠিক আছে তো ? মানে রাতে ঠিকমত ঘুম—’
সম্বিতবাবুকে কথা শেষ করতে না দিয়ে একগাল সাদা দাড়ি -গোঁফের ফাঁকে হেসে ফেলেন মহীধরবাবু, তারপর খুব মজার গলায় বলেন, ‘আসলে আপনি জানতে চাইছেন আমি পাগল হয়ে গেছি কিনা, আমার মাথার ঠিক আছে কিনা, তাই না ? এই বলে আবার হো-হো করে হেসে ওঠেন মহীধর বাবু। একটু লজ্জায় পড়ে যান সম্বিত বাবু। তাঁর মনের কোণে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নটাকে যে মহীধরবাবু এভাবে প্রকাশ্যে নিয়ে আসবেন, তা ভাবতে পারেননি সম্বিতবাবু। এবারে একটু হেসে বলেন, “না, না মহীধরবাবু, আমি কিন্তু সে কথা বলিনি; আসলে আপনি যে প্রস্তাবটা আমাকে দিলেন, এরকম একটা প্রস্তাব যে আমার কাছে কোনদিন আসতে পারে, এটা আমি ভাবতেই পারিনি। মহীধরবাবু বলেন, ‘কেন পারেননি ? প্রাচীন যুগে আমাদের এই ভারতবর্ষে যারা শিক্ষাগুরু, আচাৰ্য্য ছিলেন তারা কিন্তু ভেবেছিলেন যে প্রকৃতির কোলে ব’সে, প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে যে শিক্ষায় মানুষ গড়ে ওঠে, তাতেই এই প্রকৃতিকে ভালবাসার, পৃথিবীকে ভালেবাসার প্রাথমিক পাঠ তারা পেয়ে যায়। আর অত দূরে যাওয়ারও কোনো প্রয়োজন নেই, আমাদের অতি প্রিয় ঘরের মানুষটি, ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত, যাঁর লেখা, যাঁর কর্মধারা আমাদের প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে উদীপ্ত করে, সেই রবীন্দ্রনাথও কিন্তু শহরের কংক্রীটের জঙ্গল থেকে দূরে শান্ত প্রকৃতির কোলে গড়ে তুলেছিলেন শান্তিনিকেতন, তাঁরও উদ্দেশ্য ছিল পড়াশোনা শেখার সাথে সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন প্রকৃতিকে, এই পৃথিবীকে ভালবাসতে শেখে, প্রকৃতির যে অজস্র সম্ভার, ব্যবহারের সাথে সাথে তাকে যেন যত্ন করতে, বাঁচিয়ে রাখতে শেখে। তাই তিনি বলতে পেরে ছিলেন,
দাও ফিরে সে অরণ্য
লও এ নগর
কতখানি ক্ষোভ থেকে তিনি এ কথা বলেছিলেন ভেবে দেখেছেন কখনও? আমিও এটাই চাই; এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে প্রথমেই এই পৃথিবীকে ভালবাসতে শেখাতে চাই, তাদের বোঝাতে চাই যে যতই তারা জ্ঞান অর্জন করুক, তাদের সব জ্ঞান, সব শিক্ষাই অপূর্ণ থেকে যাবে যদি তাদের এই প্রাথমিক জ্ঞানটুকু তৈরী না হয় যে এই পৃথিবী আমাদের মা, আমাদের সবার মা। এই মা ভাল না থাকলে, সুস্থ ও সুন্দর না থাকলে আমাদের পাহাড় প্রমাণ জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা, মেধা, প্রতিভা, সৌন্দর্য সব কিছুই বৃথা হয়ে যাবে। এই পৃথিবী থাকলে তবেই আমরা থাকবো; পৃথিবীই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে আমরা কোথায় গিয়ে, কাকে গিয়ে দেখাব এই সব।
আচ্ছা বলুন তো, ‘এই পৃথিবীর ভক্ষক ও ধ্বংসক কে ?’
সম্বিতবাবু কিছুক্ষণ মহীধর বাবুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন, ‘এটা তো আপনি একেবারে চরম প্রশ্ন করেছেন - অবশ্যই আমরা; এই মানুষ নামক জীবেরা। শুধু তাই নয়, ধরিত্রী মায়ের বুক থেকে তার সবটুকু সম্পদ কিভাবে একেবারে নিংড়ে নেওয়া যায়, তার জন্যে প্রতিদিনই নতুন নতুন ফন্দী-ফিকির বের করে চলেছে।
‘এক্কেবারে ঠিক কথা বলেছেন।’ টেবিল চাপড়ে বলে ওঠেন মহীধরবাবু। সন্তানকে কিছু দিতে গেলেও বাবা-মা তাকে বলে দেন - ভোগ করো, ব্যবহার করো- কিন্তু অপব্যবহার করে নিজের জীবনে দুর্ভোগ টেনে এনো না। এই কথাগুলো তো আমরা দিব্যি বুঝতে পারি আর সেই অনুযায়ীই চলি; কি করে চলছি ? সেটা কি এই কারণেই যে সেই সম্পদ যদি সন্তান ঠিকভাবে দেখাশোনা করতে না পারে বা বাবা-মায়ের প্রতি তাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন না করে, তাহলে বাবা-মা যে কোনো মুহূর্তে তাকে সেই সম্পদ চ্যুত করতে পারে ? আর নির্মম হৃদয়হীন ভাবে কি পৃথিবীর সম্পদ লুঠ করা যায় এই কারণেই যে, তার মুখে কোনো ভাষা নেই বা সে কোনো প্রতিবাদ করেনা, তাই ? আর প্রায়ই ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী যে অসন্তোষের বার্তা পাঠায়, সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান জীব হয়েও সেই সতর্কবার্তা আমরা কেন বুঝতে পারি না ? আমাদের তো উচিত সেই অনুযায়ীই চলা আর প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসাবে পৃথিবীকে সুন্দর রাখা।
এই কথাগুলোই আমি ওদের বোঝাতে চাই, কিন্তু সেটা এই চার দেওয়ালের ভেতর ক্লাসরুমে বসে হবে না; উন্মুক্ত আকাশের তলায়, গাছের ছায়ায় বসে ঠাণ্ডা হাওয়া যখন শরীর, মনকে স্নিগ্ধ করবে, তখনই এই কথাগুলো ওদের কাছে অর্থবহ হয়ে উঠবে, ওদের শিশুমন অজস্র প্রশ্নে তোলপাড় হবে; একটা নতুন পথের দিশা দেখতে পাবে ওরা। আর ঐ পথের দিশাটুকু দেখানোই আমার কাজ। আর এই কারণেই আমার ক্লাসগুলো আমি খোলা মাঠে করাতে চাই; আপনি আমাকে শুধু এটুকু অনুমতি দিন।’
নেমে আসা চশমাটা ঠেলে তুলে দিয়ে সম্বিতবাবু বলেন, ‘আমার মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায় যে আপনি ভূগোলের শিক্ষক না বাংলা সাহিত্যের। যাক, আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই, এর আগের বার পরিচালন সমিতির চাপ আমি অনেক কষ্টে সামলেছিলাম, অভিভাবকদের চাপটাও বড় কম ছিল না। কিন্তু আমি সবার সঙ্গেই লড়াই করে গিয়েছি, তাদের বার বার বোঝানোর চেষ্টা করে গেছি যে আপনি যা যা বলেছেন সেগুলো পাগলের প্রলাপ নয়; এই গ্রহ, আমাদের এই অতি প্রিয় পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকা না থাকার মাঝে এক অনস্বীকার্য হাইফেনের মত কাজ করেছে আপনার এই উপলদ্ধি, এই চেতনা!’এই পর্যন্ত বলে দম নেওয়ার জন্য একটু থামেন সম্বিতবাবু, আর সেই ফাঁকে মহীধরবাবু বলে ওঠেন, ‘আপনি এতটা ভেবেছেন এই বিষয়টা নিয়ে। আমার আজ খুব ভালো লাগছে এই ভেবে যে আপনার মত একজন শিক্ষিত সংবেদনশীল মানুষ আমার কথাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। আসুন না, আমরা দুজনে একসাথে মানুষকে বোঝানো শুরু করি।’ বেশ মনোযোগ দিয়েই মহীধরবাবুর কথাগুলো শুনছিলেন সম্বিতবাবু, এবার দু’হাত তুলে বলেন, ‘না মশাই, আমার স্ত্রীর নাম ধরিত্রী নয়।’ অবাক হয়ে সম্বিতবাবুর দিকে তাকিয়ে মহীধরবাবু বলেন, ‘মানে?’
‘‘আপনার সাথে আসা মানেই ক্লাসরুম ছেড়ে গাছের তলায় বা নদীর পাড়ে বসে ছেলেমেয়েদের ক্লাস করাতে চাওয়া, তারপরেই পরিচালন সমিতির গলা ধাক্কা খেয়ে চাকরিটা খোয়ানো আর বাড়িতে তার পরের ব্যাপারটা সেটা যে কি হবে, সেটা তো বুঝতেই পারছেন।” এই বলে হো-হো করে হেসে ওঠেন সম্বিতবাবু।
তার দেখাদেখি মহীধরবাবুও। টেবিলে রাখা বেলটা বাজিয়ে দেন সম্বিতবাবু। দরজা খুলে মাথা ঢোকায় মিলন। সম্বিতবাবু বলেন, ‘গরম গরম দু’ কাপ চা খাওয়াও দেখি।’ মাথা নেড়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে যায় মিলন। মহীধরবাবু সম্বিতবাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তাহলে অনুমতি দিচ্ছেন তো ?’