।। দ্বিতীয়।।

    ধরণীধর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সম্বিত সেনের অবস্থা আজ বড়ই শোচনীয়। স্কুলে এসে এখনও অবধি নিজের চেয়ারে বসেননি। সমানে পায়চারি করে যাচ্ছেন আর মাঝে মাঝে টেবিলে রাখা জলের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। তাঁর এই অবস্থার জন্য দায়ী স্কুল পরিচালন সমিতির সদস্যদের পাঠানো একটা চিঠি। সেই চিঠিতে স্কুলের ভূগোলের স্যার মহীধর সেনগুপ্তের দীর্ঘদিন কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই কামাই করা এবং নিজের মনগড়া কিছু আজগুবী তত্ত্ব ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রচার করার মত গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। চিঠিতে আরও জানানো হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখ থেকে বিষয়টি শুনে তাদের অভিভাবকদের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। মহীধরবাবুর আচরণে স্কুলের সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে সম্বিতবাবুর এই বিষয়টা পরিচালন সমিতিকে জানানো উচিত ছিল। অবিলম্বে তিনি যেন মহীধরবাবুকে ডেকে এ ব্যাপারে মীমাংসা করেন। তা নাহলে পরিচালন সমিতি তাঁকে শো-কজ করতে বাধ্য হবে। বেল বাজানোর জন্য হাত বাড়াতে যেতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে পিওন মিলন। সম্বিতবাবু কোনো প্রশ্ন করার আগেই বলতে থাকে, ‘স্যার, মহীবাবু আসছেন’।
    ‘আসছেন মানে স্কুলে ঢুকেছেন না কোনো গাছতলায় গিয়ে বসে আছেন এখন?’
    ‘না। স্যার, এই আপনার রুমের দিকেই আসছেন।’
     ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি বাইরে থাকো, দরকার পড়লে ডাকবো তোমাকে।’
    কথা বলতে বলতেই মিলনের পাশ দিয়ে ঘরে ঢোকেন মহীধরবাবু। সটান চেয়ার টেনে বসে পড়েন। মিলন একবার সম্বিতবাবুর দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায়। সম্বিতবাবু এসে বসেন উল্টোদিকের চেয়ারে। মহীধরবাবুর মুখোমুখি বসে বলেন, ‘কি ব্যাপার বলুন ত আপনার? আপনি কি চান যে আপনার জন্য আমার চাকরিটা যাক ?’
পুরু লেন্সের ভেতর দিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে সম্বিত বাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন মহীধর, তারপর বললেন, ‘আবার সেই স্বার্থপর চিন্তা; আমি আমার – আচ্ছা আপনি তো সম্বিত, মানে আপনার মধ্যেই তো জ্ঞান রয়েছে, তা আপনিও স্বার্থপরই হবেন। ওই শব্দটাকে একটু উল্টে দিয়ে ভাবুন না।’
    ‘মানে?’ অবাক সম্বিতবাবু প্রশ্ন করেন।
    ‘মানেটা হল, ওই শব্দটাকে উল্টে দিলে হয় পরস্বার্থ, আর পরস্বার্থ মানে হল সবার স্বার্থ।’
    ‘আবার আপনি এইসব শুরু করলেন ? আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, এইসব নিয়েই গণ্ডগোল শুরু হয়েছে।’
    ‘আর আপনি কেন বুঝছেন না, এখুনি শুরু করতে না পারলেই ভয়ংকর গণ্ডগোল হবে, আর সেই গণ্ডগোল কিছুতেই থামানো যাবে না।’
    সম্বিতবাবু খুব বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কি গণ্ডগোল ? কিসের গণ্ডগোল।’
    ‘গণ্ডগোল এটাই যে এই মুহূর্ত থেকে যদি আমরা পৃথিবীর সব সম্পদ যেমন নদী, পাহাড়, অরণ্য —এই সব সংরক্ষণের কাজ শুরু না করি, লোভী মানুষের পৃথিবীর সব সম্পদ লুঠ আর ধ্বংস করার মারাত্মক প্রবণতাকে যদি রদ না করতে পারি, তাহলে যে মানব সভ্যতার উন্নতি নিয়ে আমাদের এত অহংকার, অচিরেই সেই সভ্যতার সমাধি হয়ে যাবে।’
    এতক্ষণ চুপ করে একমনে মহীধরবাবুর কথা শুনছিলেন সম্বিতবাবু। এবারে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলেন, “আপনার সম্পর্কে যখন নানা দিক থেকে নানান কথা কানে আসা শুরু হয়, ভীষণ বিব্রত বোধ করি, খুব রাগ হয় আপনার উপর, কিন্তু আপনি যখন সামনে আসেন, আপনার কথা শুনি,’ একটু থেমে বলেন, ‘তখন আপনাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে, শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে। এ এক রহস্যময় ব্যাপার।’
    এতক্ষণ টেবিলের উপর রাখা গ্লোবটা মনোযোগ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলেন মহীধরবাবু, এবার সম্বিতবাবুর দিকে তাকিয়ে মজার গলায় বললেন, ‘সত্যিই রহস্যময়! এই পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে আমাদের আসা, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকা, তারপর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া—সবটাই রহস্যময়। তাই না!’
    ‘কি রকম ?’ প্রশ্ন করেন সম্বিতবাবু।
    ‘এই যে ধরুন পৃথিবীতে এত রকমের জীবজন্তু থাকতে আমি, আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হয়ে জন্মালাম, এটাই তো প্রথম রহস্য। আপনার, আমার ইচ্ছেতে নয়। আমরা এসেছি অন্য কারোর ইচ্ছেতে। তিনিই আমাদের সৃষ্টিকর্তা। সেই আসাটা কি ভাবে? দুজন নারী-পুরুষের মাধ্যমে, কিছু বিশেষ প্রক্রিয়ার দ্বারা। সৃষ্টিকর্তার কি আশ্চর্য হিসাব দেখুন, মাতৃগর্ভের মত এক নিশ্চিন্ত, নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থাও করেন তিনিই। তারপর ভূমিষ্ঠ হওয়া,বেড়ে ওঠা আর তারপর কালের অমোঘ নিয়মে মৃত্যু। অর্থাৎ মাটিতে জন্মানো, আবার মাটিতেই মিশে যাওয়া। অদ্ভূত নয়, রহস্যময় নয় এই জার্নি ! কিন্তু এই আসা আর যাওয়ার মাঝের যে সময়টুকু, সেটা আমরা নিজের স্বার্থ, লাভ আর হানাহানি করেই কাটিয়ে দিই। একবারও ভেবে দেখিনা, যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের এমন একটা জায়গায় পাঠালেন, যেখানে আমাদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগের জন্যে সবকিছুই মজুত রয়েছে, সেই পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ করাও তাঁরই নির্দেশ আমাদের প্রতি। কিন্তু আমরা আদৌ এই ব্যাপারে কোন আগ্রহ ও উৎসাহ দেখাই না। সচেতন হওয়ারও চেষ্টা করিনা। আর তাই সৃষ্টিকর্তা মাঝে মাঝেই আমাদের ওপর ভয়ংকর রেগে যান আর তার পরিণতি হল পৃথিবীর যেখানে সেখানে যখন তখন তীব্র ভূমিকম্প, প্রবল সুনামি,মহামারী,মারাত্মক প্রাণঘাতী ঝড়; যার ফলশ্রুতি হল নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে হাজার হাজার প্রাণহানি আর মানব-সভ্যতার দম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল সব সৌধের ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে মূহূর্তে মাটিতে মিশে যাওয়া। শুধু যে মানুষের বসবাসের জন্যে ভোগ, বিলাসের যাবতীয় উপকরণ দিয়ে সাজানো সৌধগুলো ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশে যায় তা নয়, মানুষের তৈরী বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়গুলিও চরম বিপর্যয়ের শিকার হয়। এ থেকে কি প্রমাণ হয় বলুন তো?’
    ‘কি প্রমাণ হয়?’ বিস্মিত জিজ্ঞাসা সম্বিতবাবুর।
    ‘প্রমাণ হয় এটাই যে সৃষ্টিকর্তার একান্ত ইচ্ছে, তাঁর নিজের অতি প্রিয় এই পৃথিবী, তাঁর অফুরন্ত, অপার সৌন্দর্যময় প্রাকৃতিক সম্পদ-এর মধ্যেই মানুষ খুঁজে নিক তাকে, একই সঙ্গে ভোগ ও উপযুক্ত সংরক্ষণ করুক প্রকৃতির সম্পদকে। মানুষের তৈরী কোনো রুদ্ধ কক্ষে আবদ্ধ করার চেষ্টা হোক তাঁর অপার মহিমাকে, এ তাঁর একান্ত অনিচ্ছা। আর সেই চরম অনিচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ এইসব মারাত্মক বিপর্যয়। আমরা এক বারও ভেবে দেখিনা, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে অন্যায়, যে ভুল করে গেছে তার কুফল ভোগ করছি আমরা; আবার যে অন্যায় আমরা করছি, নির্বিচারে পৃথিবী ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছি তার ফলশ্রুতিতে বড় ভয়ংকর পরিণতি অপেক্ষা করে আছে আমাদের উত্তরসূরীদের জন্য। আমাদের মানুষ-জন্ম নিয়ে এই পৃথিবীতে আসার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার আমাদের প্রতি অনেক ইশারা, ইঙ্গিত আর নির্দেশ লুকিয়ে আছে। সেই ইশারা, সেই নির্দেশ বড় নিঃশব্দচারী আর রহস্যময় বলেই আমি মনে করি। সেই রহস্য সেইদিনই উন্মোচিত হবে, যেদিন সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেকে আমরা বুঝতে পারব, সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে পারব আর বুঝতে পারব যে আমাদের পার্থিব উন্নতি যতই হোক না কেন, সে সবই বৃথা হয়ে যাবে যদি এই পৃথিবীকে সুন্দর না রাখতে পারি, তাকে নির্মল না রাখতে পারি, প্রাকৃতিক সম্পদকে নির্বিচারে ভোগ ও ধ্বংস না করে, তাকে যদি সংরক্ষণ না করতে পারি।’
    এই পর্যন্ত বলে হাঁফাতে থাকেন মহীধরবাবু আর মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন সম্বিতবাবু।